আমাদের শরীরে Angiotensin-converting enzyme 2 (ACE2) এনজাইম প্রোটিনটি শ্বাসতন্ত্র, হৃদযন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র এবং কিডনীর কোষের বহিঃস্থ মেমব্রেনে অবস্থিত। এর মূল কাজ হলো শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখা। অপর একটি এনজাইম রয়েছে নাম Angiotensin-converting enzyme (ACE), যা Angiotensin I কে Angiotensin II তে রূপান্তর করে ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। আমরা বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করি (যাদের নামের শেষে প্রিল রয়েছে, রেমিপ্রিল, ক্যাপ্টোপ্রিল, পেরিন্ডোপ্রিল ইত্যাদি) উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য। এই ওষুধগুলি Angiotensin-converting enzyme (ACE) এর কাজকে প্রতিহত করে। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের শরীরেই ACE2 এনজাইম প্রোটিনটি দিয়েছে যা ACE এর কাজকে প্রতিহত করে, অর্থাৎ Angiotensin II কে Angiotensin I তে রূপান্তর করে। ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়। কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভুত লীলাখেলায় করোনা ভাইরাস এই এনজাইমের সহায়তা নিয়ে সুস্থ কোষের ভিতরে প্রবেশ করে। তাই বলা হয় উপরোল্লিখিত ওষুধগুলো কেউ খেলে তাদের Angiotensin-converting enzyme (ACE) প্রোটিনটি প্রায় অকার্যকর হয়ে থাকে। অন্যদিকে ইঁদুরে দেখা গেছে ঐসব ওষুধ খেলে ACE2 এনজাইমটির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ করোনা ভাইরাস সেই ওষুধগ্রহণকারি রোগীর ক্ষেত্রে বেশি দ্রুত তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তাই অনেকে সন্দেহ করে এইসমস্ত ওষুধের রোগীরা বেশি আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং এই Angiotensin-converting enzyme 2 (ACE2) এনজাইম প্রোটিনটির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারলে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমতে পারে।
স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনটি ট্রাইমেরিক অর্থাৎ তিনটি মনোমারের সংযোগ। দুটি কার্জকর সাবইউনিট রয়েছে, (S1) এবং (S2)। দুটি সাবইউনিটের কাজ অত্যন্ত মজাদার। অনেকটা সিনেমার গল্পের মতো। (S1) সাবইউনিটটি আমাদের শ্বাসতন্ত্রের কোষের উপরিভাগে অবস্থিত Angiotensin-converting enzyme 2 (ACE2) প্রোটিনটির সাথে যুক্ত হয়, যা অন্যান্য বাদুড়ের থেকে আসা SARS-CoV ভাইরাসের মতোই। তাতে কিন্তু ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে না। শরীরে প্রবেশ করতে হলে তার (S2) সাবইউনিটের প্রয়োজন। এই সাবইউনিটে ভাইরাস এবং সুস্থ দেহকোষের মেমব্রেন পর্দা ভাঙ্গনের (ফিউশন) ক্ষমতা রয়েছে। ভাইরাসটি নিজেই নিজের মেমব্রেন পর্দা এবং সুস্থ দেহকোষের মেমব্রেন পর্দা ভেদ করতে হলে মানুষের প্রোটিওলাইটিক এনজাইমের (ফিউরিন) সাহায্য নিতে হবে। তা না হলে শুধু দেহকোষের উপরিভাগে যুক্ত হলেই তো দেহকোষটিকে ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে মানবের শরীরের প্রোটিওলাইটিক এনজাইমকে ব্যবহার করার ক্ষমতার উপর থেকেই বোঝা যায় এটি প্রাণী (জুনোটিক) থেকে আগত ভাইরাস।
MERS-CoV ভাইরাসের স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনটি মানবের শরীরের প্রোটিওলাইটিক এনজাইম ফিউরিনকে ব্যবহার করে ব্যবহৃত কোষ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ একটি সুস্থ কোষকে আক্রান্ত করে নিজের অনেকগুলো প্রতিলিপি তৈরি করে সেই কোষ থেকে বেড়িয়ে যাবার সময় সে এই ফিউরিন প্রোটিনকে ব্যবহার করে। অথচ SARS-CoV ভাইরাসের স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনটি একটি সুস্থ কোষকে আক্রান্ত করার সময়ই এই ফিউরিন প্রোটিনকে ব্যবহার করে। দুই ভাইরাসের দুই রকম সময়ে একই কাজ হচ্ছে। উগান্ডার বাদুড় থেকে প্রাপ্ত MERS-CoV ভাইরাসের স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনটি মানবের শরীরের সুস্থ কোষে যুক্ত হতে পারে কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু প্রোটিয়েজ ট্রিপসিন যদি এখানে কোনভাবে যুক্ত হয়, তাহলে সেই ভাইরাসটি সুস্থ মানুষের ফিউরিনকে ব্যবহার করে দেহকোষের ভিতরে ঢুকতে সমর্থ হয়। যা MERS-CoV ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয় নি। ফলে তা এতো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে নি।
অন্যদিকে এখনকার SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনের সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে এখানে (S1/S2 সাবইউনিটের সংযোগস্থলে) ফিউরিন ক্লিভেজ করার মতো সাইট রয়েছে। যেটার প্রোটিন সিকোয়েন্স ২০১৩ সালে ইউনান প্রদেশের একটি বাদুড়ের (RaTG-13) সাথে অনেক মিল রয়েছে। অথচ ঐ বাদুড়ে ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট ছিল না। অর্থাৎ অন্য কোন বিটা করোনা ভাইরাসে এই ক্লিভেজ সাইটের উপস্থিতি নেই। তাহলে এই ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট কোথা থেকে আসলো এই ভাইরাসে? এই ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট থাকার কারণেই এই বাদুড় থেকে আসা ভাইরাসটি এতো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
ফিউরিন হলো আমাদের শরীরের বড় বড় অকার্যকর প্রোটিনকে ভেঙ্গে ছোট ছোট কার্যকর প্রোটিনে রূপান্তর করে। এটি টাইপ-১ মেমব্রেন প্রোটিয়েজ এনজাইম যা আমাদের শরীরের নানান জায়গায় আছে, বিশেষ করে ফুসফুসে। এদেরকে প্রোপ্রোটিন কনভার্টেজ এনজাইম বা বৃহৎ অর্থে প্রোটিওলাইটিক এনজাইমও বলে। আমাদের শরীরে প্রোটিন সংশ্লেষণের সময় সাধারনত প্রয়োজনের তুলনায় বড় বড় প্রোটিন তৈরি হয়। যেমন ধরুন ইনসুলিন প্রোটিন। এই ইনসুলিন সংশ্লেষণের ধাপের প্রথমে প্রিপ্রোইনসুলিন নামের ১১০ অ্যামাইনো এসিডের একটি প্রোটিন তৈরি হয় যা শারীরিকভাবে অকার্যকর। এরপর সেরিন প্রোটিয়েজ এনজাইম নামক প্রোটিওলাইটিক এনজাইমের মাধ্যমে এটি প্রোইনসুলিন প্রোটিনে রূপান্তর হয়, যা ৮৬ অ্যামাইনো এসিড সংবলিত অকার্যকর প্রোটিন। এরপর আবার সেরিন প্রোটিয়েজ এনজাইমের সহায়তায় ভেঙ্গে ৫১ অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ ইনসুলিন তৈরি করতে হয়। খাদ্যের (ডিম, মাছ, মাংস) মাধ্যমে পাওয়া বড় বড় প্রোটিনকে ভেঙ্গে ছোট ছোট প্রোটিনে রূপান্তর করে ট্রিপসিন, পেপসিন নামক প্রোটিওলাইটিক এনজাইম।
আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলছি ফিউরিনকে ব্যবহার করে সাধারন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাসটি। যেখানে এইচএ গ্লাইকোপ্রোটিনটিকে কেটে সুস্থ কোষের ভিতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা রয়েছে। যেহেতু এই ভাইরাসের আক্রমণাত্মক প্যাথোজেনিক ভূমিকা নেই, আমরা বেঁচে গিয়েছি। অন্যদিকে Avian H5N1 influenza তেও এই ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট রয়েছে। এর প্যাথোজেনেসিটি কিছুটা বেশি হওয়ায় আমরা কিছুদিন ভুগেছি। এছাড়া এইচআইভি, ডেঙ্গু , এবোলা ভাইরাসের এই ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট রয়েছে।
এখনকার SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনের ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট থাকাটিকে ‘গেইন অফ ফাংশন’ হিসেবে বলা হয় যার ফলে এটি বাদুড় থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা পেয়েছে। অনেকে বলছেন এই ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটটি হয়তো অন্য কোন ভাইরাস থেকে এই ভাইরাসে আসতে পারে যা এক হাজার বছর আগে যুক্ত হয়েছে অথবা উহানের সাম্প্রতিক সংক্রমণের এক সপ্তাহ আগে নতুন ভাইরাসটিতে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ বাদুড় থেকে মানুষে আসার মাঝখানে কোন একটি ঘটনা হয়েছে। যার হদিস এখনো পাওয়া যায় নি। সৃষ্টিকর্তা ভালো জানবেন মাঝখানে কোন প্রাণীর বা ভাইরাসের সাথে এই ভাইরাসের মিলন হয়েছে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।