করোনা ভাইরাল রেপ্লিকেশন পদ্ধতি

মোঃ আব্দুল মুহিত

SARS-CoV-2 ভাইরাসটি মানবদেহের সুস্থ কোষে ঢুকে কি কি করে তার একটা বিস্তারিত বর্ণনা প্রয়োজন। ইহাকে বলে ভাইরাল রেপ্লিকেশন। এটিকে ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হলো। (নিচের ছবি-১ এর সাথে মিলিয়ে পড়ুন, বুঝতে অসুবিধা হবে না আশাকরি)

ছবি-১

১।সুস্থ কোষে সংযুক্ত হওয়াঃ SARS-CoV-2 ভাইরাসটি তার স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিনের সাহায্যে আমাদের শরীরের শ্বাসতন্ত্রের সুস্থ কোষের Angiotensin-converting enzyme 2 (ACE2) এনজাইম প্রোটিনটির সাথে সংযুক্ত হয়। (বিস্তারিত বর্ণনা আগের লেখায় দেয়া হয়েছে)

২। ভিতরে প্রবেশঃ পুরো ভাইরাসটিকে আমাদের কোষ এন্ডোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় গিলে ফেলে অর্থাৎ আমাদের কোষের ভিতরে ভাইরাসটিকে টেনে নিয়ে আসে ।

৩। ট্রান্সলেশন অর্থাৎ প্রোটিন তৈরিকরণঃ কোষে ঢুকে পড়ামাত্রই ভাইরাসটির Positive Sense RNA’র ৫’ থেকে ৩’ দিকে আমাদের রাইবোজোম পড়া শুরু করতে পারে। ভাইরাসটির আরএনএ জেনোমের ৫’দিকের দুই-তৃতীয়াংশতে যে প্রথম ওপেন রিডিং ফ্রেম (ORF1a/b) রয়েছে অর্থাৎ ১নং জিন থেকে দুটি বড় প্রোটিন তৈরি করে, নাম পলিপ্রোটিন (pp1a এবং pp1ab)।

৪। প্রোটিওলাইসিসঃ বড় বড় দুটি প্রোটিনগুলো ছোট ছোট ১৬টি ননস্ট্রাকচারাল প্রোটিন (nsp1-nsp16) তৈরি করে। এতে সাহায্য করে ভাইরাসটির নিজস্ব দুটি এনজাইম প্রোটিন, নাম হলো papain-like (SARS-PLpro) যা nsp3 প্রোটিন এবং Chymotrypsin-like folds (SARS-3CLpro) যা nsp5 প্রোটিন । এই ১৬টি প্রোটিন মিলে হয় রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ কমপ্লেক্স।

৫। ডাবল মেমব্রেন ভেসিকলঃ রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ কমপ্লেক্স প্রথমেই আমাদের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে ডাবল মেমব্রেন ভেসিকল তৈরি করে।

৬। রেপ্লিকেশন এবং ট্রান্সক্রিপশনঃ রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ কমপ্লেক্স থেকে RNA dependent RNA Polymerase (RdRp) এনজাইমটি পুরো RNA থেকে নতুন একটি ৫’-৩’Positive Sense RNA কপি তৈরি করে (রেপ্লিকা তৈরি)। এরপর এখান থেকে একটি টেমপ্লেট (নকল) অর্থাৎ ৩’-৫’Negative Sense RNA তৈরি করে। এই টেমপ্লেট থেকে সাব-জেনোমিক বাকি ১২টি ছোট ছোট ৩’-৫’Negative Sense mRNA তৈরি করে। একে বলে Discontinuous Transcription। এই কাজে সহায়তা করে RNA dependent RNA Polymerase (RdRp) এনজাইমটি । এটা থেকে প্রোটিন তৈরি করা যাবে না। কারণ আগেই বলেছি প্রোটিন তৈরি করতে হলে ৫’-৩’Positive Sense mRNA লাগবে। তাই ৩’-৫’Negative Sense mRNA থেকে আবার ৫’-৩’Positive Sense mRNA তে রূপান্তর করা হয়। বারংবার ট্রান্সক্রিপশন কাজে যাতে কোন ভুল না হয় বা অন্য কোন খারাপ মিউটেশন না ঘটে, সে জন্য প্রুফ রিডিং করতে হয়। এটাই করোনাভাইরাসের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য। এক্সোরাইবোনিউক্লিয়েজ (ExoN) নামক একটি nsp14 প্রোটিন, এই কাজটি করে থাকে।

৭। স্ট্রাকচারাল প্রোটিন ট্রান্সলেশনঃ ১২টি ছোট ছোট ৫’-৩’Positive Sense mRNA থেকে ভাইরাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারটি স্ট্রাকচারাল প্রোটিনসহ অন্যান্য প্রোটিন তৈরি হওয়া শুরু হয়। এগুলো ভাইরাসের মূল শরীর গঠন করে। যেমন স্পাইক (S) প্রোটিন, এনভেলপ (E), নিউক্লিওক্যাপসিড (N) এবং মেমব্রেন (M)। অন্যান্য প্রোটিনগুলোর কাজ এখনো অজানা। তবে ধারণা করা হয় তারা মানবদেহের অ্যান্টিবডি থেকে নিজেদের সুরক্ষা দেয়।

৮। ER–Golgi intermediate compartment (ERGIC) গঠন এবং অ্যাসেম্বলিকরণঃ নব্য সৃষ্ট ভাইরাল চারটি স্ট্রাকচারাল প্রোটিনসহ অন্যান্য প্রোটিনগুলি এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম (ER) এবং গলজি বডিজের গায়ে লেগে যায়। ফলে একটি কমপ্লেক্স গঠন হয় যার নাম (ERGIC)। এখানে মেমব্রেন ভেসিকলের ভিতরে ৫’-৩’Positive Sense RNA (রেপ্লিকা), নিউক্লিওক্যাপসিড (N) এর ভিতরে প্রবেশ করে। অন্যান্য প্রোটিনসমূহ যুক্ত হয়ে নতুন একটি ভাইরাস তৈরি হয়ে যায়।

৯। নতুন ভাইরাসটি রিলিজঃ সদ্য তৈরিকৃত ভাইরাসটি আমাদের কোষের এক্সোসাইটোসিস প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ভেসিকল মেমব্রেন ভেদ করে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় আমাদের কোষটি মারা যায়। এই ভাইরাসটি নতুন একটি কোষকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা পায়।

ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানঃ

তবে ভাইরাল রেপ্লিকেশন জানতে হলে ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হবে। চেষ্টা করবো খুব সংক্ষেপে পাঠকদের ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিন নিয়ে ধারণা দিতে। নতুন SARS-CoV-2 ভাইরাসটির জেনোমের কোড Positive Sense Single Stranded RNA (ধনাত্মক একসূত্রক) তে রয়েছে। এই জেনোমে যেখানে হাতে গোনা ১৩টির মতো জিন রয়েছে যা প্রায় ৩০ হাজার নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে মানুষের জেনোম কোড Double Stranded DNA (দ্বিসূত্রক) তে সংরক্ষিত, যেখানে প্রায় ৪৬ হাজার জিন (এখন পর্যন্ত জানা )যেগুলো প্রায় ৩০০ কোটি নিউক্লিওটাইড বেজ দিয়ে তৈরি।

তাহলে বুঝতেই পারছেন নতুন ভাইরাসটির জেনোম আমাদের থেকে কতো ছোট। আমি আগেই বলেছি আমাদের শরীরে ডিএনএ থেকে মেসেঞ্জার আরএনএ এবং সেখান থেকে প্রোটিন তৈরি হয়। ডিএনএ থাকে আমাদের কোষের নিউক্লিয়াসে। মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি হওয়ার পর তা নিউক্লিয়াস থেকে বের হয়ে কোষের সাইটোপ্লাজমে (নিউক্লিয়াস ছাড়া বাকি অংশকে সাইটোপ্লাজম বলে) আসে। সেখানে প্রোটিন তৈরি হয়, যা নানাবিধ শারীরিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। অথচ SARS-CoV-2 ভাইরাসটির Positive Sense Single Stranded RNA (ধনাত্মক একসূত্রক) নিজেই একটি মেসেঞ্জার আরএনএ অর্থাৎ মানব শরীরের রেপ্লিকেশনের তুলনায় এক ধাপ এগিয়ে। কোন রকমে সুস্থ কোষে ঢুকতে পারলেই অর্থাৎ সে সাইটোপ্লাজমে এসে নিজের প্রোটিন তৈরি করা শুরু দেয়।

ডিএনএ মানে ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড। তাদের গঠনে নিউক্লিক এসিডের সাথে ডিঅক্সিরাইবোজ সুগার যুক্ত আছে। নিউক্লিক এসিডের বেইজ শুধুমাত্র চারটি আছে। অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G), থায়ামিন (T) ও সাইটোসিন (C)। এদের সাথে একটি সুগার এবং ফসফেট গ্রুপ যুক্ত হলে তাকে বলে নিউক্লিওটাইড। এই নিউক্লিওটাইডগুলি একের পর এক বসে এই জেনোম তৈরি করেছে।একটি জিন হচ্ছে সেই সম্পূর্ণ জেনোমের ছোট একটি অংশ যেখানে কয়েকটি থেকে কয়েক হাজার নিউক্লিওটাইড পরপর বসে এটি তৈরি হয়েছে। যেহেতু ডিএনএ দ্বিসূত্রক, অর্থাৎ সমান্তরাল করলে এটি দেখতে একটি মইয়ের বা রেললাইনের মতো। মইয়ের একবাহুতে একটি অ্যাডেনিন (A) থাকলে তার অপর বাহুতে সমান্তরালে অবশ্যই একই জায়গায় থায়ামিন (T) আছে, আবার গুয়ানিন (G) একটি বাহুতে থাকলে অপরদিকে সমান্তরালে সাইটোসিন (C) বসে আছে। মনে রাখুন অ্যাডেনিন (A) – থায়ামিন (T) নিজেরা হাইড্রোজেন বন্ধন তৈরি করে একটি সিঁড়ি এবং গুয়ানিন (G) -সাইটোসিন (C) হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে অন্য একটি সিঁড়ি তৈরি করে। এভাবে মইটি এগিয়ে চলে। মইয়ের প্রতিটি সিঁড়ি যুক্ত হয়ে একটি ডিএনএ তৈরি হয়েছে।(নিচের ছবি-২ দেখুন)

ছবি-২

যেমন উদাহরণ হিসেবে ধরুন একটি বাহুতে ৯টি নিউক্লিওটাইড যথা ৫’-ATGCACTGA-৩ পরপর বসে আছে। তাহলে অপর বাহুতে সমান্তরালে অবশ্যই ৩’-TACGTGACT-৫’ এই নিউক্লিওটাইডগুলি আছে। এখানে দেখুন বাহুগুলির শুরু হয়েছে ৫’কিংবা ৩’ দিয়ে। তার মানে নিউক্লিওটাইডটির সাথে সংযুক্ত ডিঅক্সিরাইবোজ সুগারের ঐ জায়গায় একটি ফসফেট গ্রুপ ফাঁকা রয়েছে। যেই বাহুটিতে নিউক্লিওটাইডগুলি ৫’- ৩’এর দিকে রয়েছে তাই মূলত জিনের কোড বহন করে অর্থাৎ Sense বাহু। আর অন্য বাহুটিকে অর্থাৎ ৩’- ৫’ টেমপ্লেট বাহু বা Antisense বাহু বলে। দ্বিসূত্রক ডিএনএ থেকে একসূত্রক মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি করতে হলে, এই টেমপ্লেট বাহুর নিউক্লিওটাইডগুলির বিপরীত নিউক্লিওটাইড বসিয়ে গেলেই Sense মেসেঞ্জার আরএনএ অর্থাৎ ৫’- ৩’একসূত্রক আরএনএ তৈরি হয়ে যাবে। এই একসূত্রক মেসেঞ্জার আরএনএ তে একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের সংকেত সংরক্ষিত থাকে।

আরএনএ হলো রাইবো নিউক্লিক এসিড অর্থাৎ রাইবোজ সুগার দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে আরএনএ নিউক্লিওটাইড বেইজ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইড বেইজের মধ্যে একটি শুধু পার্থক্য বিদ্যমান। দ্বিসূত্রক ডিএনএ এর থায়ামিন (T) এর স্থলে একসূত্রকের আরএনএ তে ইউরাসিল (U) বসে। বাকি গুলো একই । অর্থাৎ উপরের কাল্পনিক ডিএনএ এর একটি জিন এর Sense মেসেঞ্জার আরএনএ হবে ৫’-AUGCACUGA-৩’। খেয়াল করে দেখুন দ্বিসূত্রক ডিএনএ এর Sense বাহুর ৫’-ATGCACTGA-৩’এই সিকোয়েন্সের দুটি (T) এর স্থলে একসূত্রকের আরএনএ তে ইউরাসিল (U) বসে গেছে। শুধু এটুকুই পার্থক্য। অর্থাৎ জিনটির পুরো তথ্য একসূত্রক মেসেঞ্জার আরএনএ ‘তে এসে গেছে। এই প্রক্রিয়াকে ট্রান্সক্রিপশন বলে।

এই মেসেঞ্জার আরএনএ টি এখন নিউক্লিয়াস থেকে বের হয়ে সাইটোপ্লাজমে আসবে। এখানে রাইবোজোম নামক অন্তকোষীয় পদার্থ রয়েছে যা একে পড়তে পারে এবং সেই মোতাবেক নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে ট্রান্সলেশন। প্রোটিন হলো অনেকগুলো অ্যামাইনো এসিডের সমষ্টি। অ্যামাইনো এসিড মোট ২২টি রয়েছে আমাদের শরীরে। কয়েকটি নাম হচ্ছে গ্লাইসিন (G), সেরিন (S), প্রোলিন (P), মিথিওনিন (M), ভ্যালিন (V), টাইরোসিন (Y) ইত্যাদি। এই ২২টি অ্যামাইনো এসিড একের পর এক বিভিন্ন বিন্যাসে বসে একটি প্রোটিন তৈরি করে। আমরা জানি মেসেঞ্জার আরএনএ ‘তে অনেকগুলি নিউক্লিওটাইড রয়েছে। পরপর তিনটি নিউক্লিওটাইড মিলে একটি আম্যাইনো এসিডের কোড বহন করে, একে বলে কোডন। যেমন ধরুন উপরের একসূত্রক Sense মেসেঞ্জার আরএনএ ‘তে (৫’-AUGCACUGA-৩’) প্রথম তিনটি নিউক্লিওটাইড হলো AUG । এই তিনটি নিউক্লিওটাইড মিলে মিথিওনিন (M) আম্যাইনো এসিডের কোড। মজার বিষয় হলো প্রাণীদেহের যেকোনো প্রোটিনের প্রথম অ্যামাইনো এসিড অবশ্যই মিথিওনিন (M) হবে অর্থাৎ স্টার্ট কোডন AUG এবং প্রোটিনটির ঐ দিকটিকে বলে N–টার্মিনাল বা শুরুর দিক। পরের তিনটি নিউক্লিওটাইড হলো CAC , যা হিস্টিডিন (H) অ্যামাইনো এসিডের কোড। সুতরাং মিথিওনিনের পরে হিস্টিডিন বসবে। বড় বড় জিনের ক্ষেত্রে এভাবে চলতেই থাকে। কিন্তু কোথায় গিয়ে থামবে? দেখুন আমাদের কাল্পনিক জিনে শেষের তিনটি নিউক্লিওটাইড হলো UGA । এই তিনটি নিউক্লিওটাইডকে বলে স্টপ কোডন। এখানে এসে থেমে যাবে প্রোটিন সংস্লেশন। এভাবে নতুন প্রোটিন তৈরি হওয়া শেষ হলে সেই প্রোটিনটি তার কার্যকারিতা দেখাতে পারে। যেমন ইনসুলিন হচ্ছে একটি প্রোটিন যেখানে ৫১টি অ্যামাইনো এসিড রয়েছে। এই ইনসুলিন আমাদের রক্তে গ্লুকোজ কমাতে সাহায্য করে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও পড়ুন: করোনা ভাইরাসের মলিকিউলার দৃষ্টিভঙ্গি: পর্ব ৩

 

করোনাকরোনা ভাইরাল রেপ্লিকেশনকরোনা ভাইরাস
Comments (০)
Add Comment