আমেরিকায় ১৮৮৮ সালের দিকে প্রথম জেনেরিক ওষুধের কারখানা তৈরির পর থেকেই ওষুধের গুণমান নিয়ে বিতর্ক তৈরী হয়। গুণমান রক্ষার জন্য আমেরিকার কংগ্রেসে ১৯০৬ সালে ‘ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাক্ট” চালু হয়। এরপরে ১৯২৮ এবং ১৯৩৮ সালে আরও পরিবর্তন/সংশোধনী আসে।
ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাক্ট (Federal Food and Drugs Act) যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০৬ সালে চালু হয়। এই আইনটি প্রাথমিকভাবে খাদ্য এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল। আইনটি প্রণয়ন করা হয় খাদ্য এবং ওষুধের ভেজাল ও ভুলভাবে লেবেলিং প্রতিরোধ করার জন্য। এটি ছিল প্রথম ফেডারেল আইন যা খাদ্য ও ওষুধের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মান নির্ধারণ করেছিল।
এই আইনটি পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে ফেডারেল ফুড, ড্রাগ, এবং কসমেটিক অ্যাক্ট (Federal Food, Drug, and Cosmetic Act) দ্বারা প্রতিস্থাপন হয়, যা খাদ্য, ওষুধ, এবং প্রসাধন সামগ্রীর নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য আরও কঠোর নিয়মাবলী তৈরী করে।
১৯৩৭ সালে Elixir Sulphanilamide-এর (জেনেরিক ওষুধ ছিল) ব্যবহারের ফলে ১০৭ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ফার্মাসিউটিক্যাল নিয়ন্ত্রণের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় বলে বিবেচনা করা হয়। এই ওষুধটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক ছিল, কিন্তু এর সলভেন্ট বা দ্রাবক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ডায়েথিলিন গ্লাইকোল (Diethylene Glycol), যা একটি বিষাক্ত রাসায়নিক।
এই ঘটনাটি ফেডারেল ফুড, ড্রাগ, এবং কসমেটিক অ্যাক্ট (Federal Food, Drug, and Cosmetic Act) ১৯৩৮ সালে প্রণয়নের পথ প্রশস্ত করে। নতুন এই আইনটি ওষুধের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য আরও কঠোর নিয়মাবলী প্রবর্তন করে। এর ফলে ওষুধ বাজারজাত করার আগে তাদের পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া এবং প্রমাণপত্রের মাধ্যমে নিরাপত্তা যাচাই করা বাধ্যতামূলক হয়।
এরও অল্পদিন পরে বিশ্বের মান্য এবং অনেকাংশে নির্ভরযোগ্য স্ব-শাসিত সংস্থা “ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA)” তৈরি হয়। FDA থেকে একটি ওষুধের বাজারে আসার জন্য লাইসেন্স পেতে অত্যন্ত কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পাস করতে হয়
আমেরিকার প্রেক্ষাপটে আগে থেকেও সীমিত পরিসরে শুরু হলেও বিস্তৃত পরিসরে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন ১৯৬০-এর দশকে শুরু হয়। সে সময়ে, ব্র্যান্ডেড ওষুধের পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অন্যান্য কোম্পানিগুলি ওই ওষুধগুলির জেনেরিক সংস্করণ উৎপাদন শুরু করে।
১৯৮৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে হ্যাচ-ওয়াক্সম্যান অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর, জেনেরিক ওষুধের বাজার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই আইনটি পেটেন্ট সুরক্ষার সময়সীমা নির্ধারণ করে এবং জেনেরিক ওষুধের জন্য ফাস্ট-ট্র্যাক অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রবর্তন করে।
পরবর্তীতে অন্য অনেক দেশ, যেমন ব্রাজিল, চীন, এবং দক্ষিণ কোরিয়া, বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনের খাতে প্রবেশ করে। এই দেশগুলি তাদের নিজস্ব জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন শুরু করে এবং গ্লোবাল মার্কেটে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে।
চীনের ফার্মাসিউটিক্যাল বাজার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং এটি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটির ওষুধ শিল্পের একটি বড় অংশ জেনেরিক ড্রাগের নিয়ন্ত্রণে। চীনের সরকার ওষুধের খরচ কমানোর লক্ষ্যে জেনেরিক ওষুধের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে।
চীনের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে চীন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (CFDA), যা বর্তমানে ন্যাশনাল মেডিকেল প্রোডাক্টস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NMPA) নামে পরিচিত। এই সংস্থা ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নিয়মাবলী প্রণয়ন করেছে। চীন জেনেরিক ওষুধের বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেনেরিক ওষুধ সরবরাহ করে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। চীনা কোম্পানিগুলি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে এবং অনেকগুলো কোম্পানি ইতিমধ্যে US FDA এবং EU EMA থেকে অনুমোদন পেয়েছে।
চীনের জেনেরিক ড্রাগ শিল্পের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন মান নিয়ন্ত্রণ, প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা। তবে সরকার ও শিল্পের যৌথ প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করছে।
ভারতে বেশ আগে থেকেই জেনেরিক উৎপাদন হলেও পেটেন্ট আইনের কিছু বাধার মুখে এই কাজ ব্যহত হতে থাকে৷ ভারত ১৯৭০ সালে পেটেন্ট আইন সংশোধন করে, যা দেশটিকে একটি প্রধান জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করে। ভারতীয় কোম্পানিগুলি কম খরচে ওষুধ উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে শুরু করে। সমগ্র পৃথিবীর ২০% জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে ভারত যেজন্য এ দেশকে “ফার্মেসি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড” বলা হয়। বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
বাংলাদেশে জেনেরিক ড্রাগ উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের ওষুধ শিল্প বিশেষ করে জেনেরিক ড্রাগ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে । বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮২ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ (Drug Control Ordinance) প্রণয়ন করা হয়। এই অধ্যাদেশটি দেশের ওষুধ উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং বিপণন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি উচ্চ মানের জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন করে এবং বিশ্বব্যাপী বাজারে রপ্তানি করে। দেশের প্রায় ৯৮% অভ্যন্তরীণ চাহিদা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধ দ্বারা পূরণ হয়। বাংলাদেশ জেনেরিক ওষুধ প্রায় ১৫০টি দেশে রপ্তানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে উচ্চ মানের ওষুধ সরবরাহের জন্য বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো GMP (Good Manufacturing Practices) অনুসরণ করে এবং অনেকগুলি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে
বর্তমানে, জেনেরিক ওষুধ বিশ্বব্যাপী ওষুধের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহের জন্য জেনেরিক ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
লেখক : ফার্মাসিস্ট, দেশীয় ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
Email: nazmulpharmapust@gmail.com