বিশ শতকের শুরুতেও বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী হোমিও চিকিৎসাতে আকৃষ্ট হতেন। মফস্বল জেলাগুলোতে হোমিওপ্যাথিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। অন্য পেশার লোকজনও সহজেই হোমিও কোর্স করে প্র্যাকটিস করতে থাকেন। উকিল এবং শিক্ষক এই দুই শ্রেণীর লোক এই পেশায় যুক্ত হন। এছাড়াও এই সময়ে মহামারী ছিল নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। জ্বর, কলেরা, বসন্ত বাংলার জনজীবনকে ব্যাহত করে তুলছিল। এ্যালোপাথিক চিকিৎসার ইনজেকশন, স্যালাইন এবং কুইনাইনের ভীতি মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছিল। ফলে হোমিও ডাক্তারদের ব্যবসা ছিল বেশ রমরমা। ডাক্তার বাবু নামে পরিচিত এসকল লোক খুব সহজেই রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রে বা ভদ্রলোক হিসেবে গণ্য হবার আকাঙ্খাও পেশাকে জনপ্রিয় করে তোলে। উনিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতা থেকে হোমিও বিষয়ক প্রচুর প্রকাশনা বের হতে থাকে। এর মধ্যে ছিল বই পুস্তক, পত্র পত্রিকা ইত্যাদি। এই প্রকাশনা সহজেই হোমিও চিকিৎসায় আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। বিশ শতকের প্রথম দিকে মহামারী ঠেকানোর জন্য অল্প শিক্ষিত লোকের বোঝার জন্য প্রচুর হোমিও চিকিৎসার বই প্রকাশ হতে থাকে। কলেরা, জ্বর, বসন্ত, নারী ও শিশু রোাগের উপর লেখা বই গুলো পড়লে খুবই অবাক হতে হয়। এগুলোর বিজ্ঞাপনেও এ ধরণের শব্দ ও বাক্য ব্যবহার হতো। উদাহরণ স্বরূপ তার দু একটির আলোচনা করা যেতে পারে- যেমন ১৯০০ খ্রি. কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ডা. কে. এন ঘোষের সচিত্র ডাক্তারী । হোমিও প্যাথিক চিকিৎসা ওলাউঠা। ঢাকার নবাব স্যার আবদুল গণী কে.সি. আই মহোদয়ের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। কলেরার উপর বইটি লিখতে গিয়ে ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, “ বর্তমান ভারতবর্ষে বিশেষত: বঙ্গদেশে ওলাউঠার আপাতত: যেরূপ প্রাদুর্ভাব হইয়াছে, এ সময় ওলাউঠা চিকিৎসার একখানি পুস্তকের বিশেষ আবশ্যক হইয়াছে। এই পুস্তকে রোগের নানা অবস্থার দৃষ্টান্ত সম্বলিত চিকিৎসা এবং প্রত্যেক চিত্র ও তাহার বিশেষ বিবরণ দেওয়াতে সকলেই অতি সহজে রোগের অবস্থা বুঝিয়া চিকিৎসা করিতে পারিবেন। ” ১৯০৭ খ্রি. ডাক্তার যদুনাথ মুখোপাধ্যায় জ্বরের উপর পূর্ণাঙ্গ তিন খন্ডের বই লেখেন। যে সময় ম্যালেরিয়া জ্বরের ভয়াবহ অবস্থা, সে সময় স্বল্প শিক্ষিত লোকের জন্য এ ধরণের বই নিশ্চয় কাজে এসেছিল। বইটি পড়ে অনেক পাঠক সেই মতামত পাঠিয়েছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে লেখা এক পাঠকের অভিমত “ মেডিকেল স্কুলে তিন বৎসর বড় বড় নামজাদা ডাক্তারের উপদেশ শুনিয়া ও বৈ পড়িয়া যে ফল না হয় আপনার বৈ আগাগোড়া একবার পড়িলেই সে ফল হয়।” এসব প্রকাশনা এখনো পড়লে বিস্মিত হতে হয়। শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা পড়লে আজকের ভাইরাস রোগ সম্পর্কে জানা সহজ হতো। ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে তিনি লিখছেন, “ ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের সহিত প্রত্যেকেই পরিচিত। অধুনা ইহা প্রায় বর্ষে বর্ষে প্রতি শীতকালে বিভিন্ন তীব্রতায় আবির্ভূত হয়। সাধারণত: উপলদ্ধি হয় না যে বিসূচিকা, আন্ত্রিকজ্বর (টাইফয়েড), গ্রন্থিকজ্বর (প্লেগ) এবং অন্যান্য ভীষণ মহামারী অপেক্ষা অধিক লোক ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি স্বভাবত:ই ক্ষীণ, এজন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণত: কয়েক বৎসর পযন্ত অদৃশ্য থাকিয়া পুনরায় প্রবল প্রকোপে আবির্ভূত হইলে জনসাধারণ, এমন কি চিকিৎসকগণও ইহাকে “নূতন ব্যাধি” বলিয়া সিদ্ধান্ত করেন।” হোমিওপ্যাথির প্রকাশনা দেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আকৃষ্ট হন। সাধারণ মানুষের কাছে ডাক্তারি ভাষার কঠিন শব্দগুলোকে তিনি বাংলা ভাষায় নতুন করে তর্জমা করে পরিবেশন করেন যাতে সাধারণ মানুষ দেহতত্বের গুরুগম্ভীরতাকে সরলভাবে বুঝতে পারে। যেমন মেডিকেল টার্মিনোলজিতে ‘ফ্যাগোসাইটিক’ কোষগুলোর কাজ হল ক্ষতিকর কোষগুলোকে গিলে ফেলা। তিনি ‘ফ্যাগোসাইটিক’ কোষের নামকরণ করেন ‘ভক্ষক কোষ’। আবার ‘ব্লাড প্লাজমা’র নামকরণ করেন ‘বর্ণহীন রস’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় কতটা পারদর্শী ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় রাণী মহলানবিশের অসুখের সময়। রাণী মহলানবিশ ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সহধর্মিনী। একবার নির্মলকুমারী মহলানবিশ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর চিকিত্সার জন্যে ডাকা হয় সে সময়ের বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ নীলরতন সরকার ও আরও অনেক চিকিৎসককে, কিন্তু তাঁর জ্বর কমাতে কেউ পারেন নি। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় নির্মলকুমারী মহলানবিশ টাইফয়েড জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করেন। তাঁর সময়ে হোমিও চিকিৎসায় যথেষ্ট সাড়া ফেলেন ডাঃ প্রতাপ মজুমদার। তিনিও বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের মতামত নিতেন।
লেখক: উপ-উপাচার্য ,পাবনা বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।