১৫ এপ্রিল ২০২০ বুধবার ভোরে করোনা আক্রান্ত সিলেটের গরিবের ডাক্তার খ্যাত মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর দু:সংবাদে ঘুম ভাঙে আমার মত সকলেরই। মন খারাপের মতো এক ভয়ানক দু:সংবাদ আর শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চিরবিদায় নিলেন এই জনপ্রিয় চিকিৎসক । তাবৎ পৃথিবীর লাখো মানুষ এখন এক অদৃশ্য শত্রেুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। করোনা এখন এতোটাই ক্ষমতাবান হয়ে গেছে, আমাদের সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে লকডাউনে গোটা পৃথিবী। এক অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে অসহায় গোটা মানব জাতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গত মাসে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ক্লোরোকুইন কাজ করবে বলে জানিয়েছিল।
বাস্তবেই তাই আজকের মত মহামারি অতীতে অনেকবার সৃষ্ট হয়েছে ম্যালেরিয়ার কারণে। ম্যালেরিয়াকে অতীতে দানব বলে চিহ্নিত করা হতো। পৃথিবীর নানান সভ্যতার সময়ে এই অসুখ দেখা দিয়েছে। এই রোগের নাম প্রাচীন সকল সভ্যতাতেই পাওয়া যায়। মিশরীয়, সুমেরীয়, এমনকি ভারতীয় সভ্যতায় সুশ্রুতার বিবরণীতেও।
বাইবেলে আছে যে এসেরিয়ার রাজা সেনাচেরিব জুডা রাজ্য অবরোধ করতে গেলে এক অজ্ঞাত রোগে সেনাচেরিবের সৈন্যরা মারা যায়। সম্রাট হেজেকিয়া এবং জেরুজালেমের অধিবাসীরা রক্ষা পান। গবেষকদের ধারণা ম্যালেরিয়া রোগে সেনাচেরিবের সৈন্য সামন্ত বিনষ্ট হয়েছিল। এই উপাখ্যানের প্রায় দুই হাজার বছর পরে একই ধরণের ঘটনার পুণরাবৃত্তি দেখা যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইংরেজ সৈন্যগণ জর্ডান উপত্যকা অধিকার করার সময় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। ফলে ইংরেজ সৈন্যদের আগমনের রাত্রিতেই অর্ধেক সৈন্য মারা যায়। একইভাবে গ্যালিপোলিতে প্রায় ২০ হাজার সৈন্য মারা যায়। ফলে তুরস্কের বিজয়ের রাস্তা সহজ হয়ে যায়। আবার নেপোলিয়ন যখন প্যালেস্টাইন আক্রমণ করেন তখনও ম্যালেরিয়া জীবাণু নেপোলিয়নের সৈনিকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন।
পানামা খালের ইতিহাসেও ম্যালেরিয়া অনেক উত্থান পতন দেখিয়েছিল। প্রথমে পানামা খাল খনন করতে দেয়া হয়েছিল ফরাসী প্রকৌশলী ডি লেসেপসকে। কেননা ইতিপূর্বে সুয়েজ খাল খননে তাঁর কৃতিত্ব ছিল। কিন্তু ম্যালেরিয়া তাঁর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। কিন্তু খাল তৈরি করতে গিয়ে প্রায় বিশ হাজার লোক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ডি লেসেপস্ এর কোম্পানী দেউলিয়া হয়ে যায়। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যায়। ডি লেসেপস্ কে অকৃতকাযের দায় গ্রহণ করতে হয় এবং তিনি বন্দী হন। কারাগারেই তাকে প্রাণত্যাগ করতে হয়। পরে আমেরিকা নতুনভাবে অর্থ বিনিয়োগ করে। আমেরিকার অর্থে পানামা খাল নির্মাণের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়। গল্পটি এখানেই শেষ নয়। ফ্রান্স কোম্পানীর দুর্বলতা খুঁজতে গিয়ে আমেরিকান কোম্পানী খাল খনন বাদ দিয়ে তারা জ্বরের কারণ খুঁজে বের করল। গবেষণায় দেখা যায় হাজার হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর পিছনে ছিল ম্যালেরিয়ার জীবাণু। তারা দেখল মশার মাধ্যমে ওই এলাকায় জ্বর ছড়াচ্ছে। এ কারণে তারা মশার প্রতিষেধক কাজে নিয়োজিত হয়ে বছর দেড়েকের মধ্যে মশা দূর করতে সক্ষম হন । পরে পানামা খাল তৈরীর কাজে হাতে দেন এবং সফল হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! এই সময়ে একটি কথা প্রচলিত ছিল যে জাপানীদের হামলায় যতজন সেনা মারা গেছে তার চাইতেও বেশী মারা গেছে ম্যালেরিয়াতে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যালেরিয়ার হাত থেকে সৈনিকদের রক্ষা করার জন্য মিত্র শক্তির সৈন্যবাহিনী সারা ইউরোপজুড়ে ডিডিটি স্প্রে করেছিল।
আঠারো থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পযন্ত উপনিবেশ বিস্তারে ইউরোপের দেশগুলোর প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ম্যালেরিয়া। বাংলার বাঘ এবং ম্যালেরিয়া ছিল ইউরোপীয়ানদের একমাত্র ভয়ের উৎস। এর প্রমাণ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ফুলের মূল্য গল্প। এখানে যেমন- দরিদ্র ইংরেজ জননীর কাছে ভারতবর্ষ সর্প ব্যাঘ্র আর দুরারোগ্য ব্যাধির দেশ। এমন ভয়ংকর দেশে গিয়ে পুত্র কেমন আছে তাই নিয়ে জননীর দুর্ভাবনার অন্ত নেই।” ম্যালেরিয়ার হাত থেকে উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর প্রতিকারের কোন বিকল্প ছিল না। এজন্য ম্যালেরিয়া জীবাণু আবিস্কারে ইউরোপীয় দেশগুলো আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। ১৮৬০ সালের পর এই চেষ্টা আরো জোরদার হয়। ম্যালেরিয়া নিয়ে দেশ বিদেশে ছিল ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার এবং নানা রকমের ভিন্নমত। এর বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন খ্যাতিমান অনেক বিজ্ঞানী। এদেরই একজন ফ্রেঞ্চ আর্মির ডাঃ আলফনসে লাভেরান । শত শত ম্যালেরিয়া রোগী পর্যবেক্ষণ করে লাভেরান একটা জিনিসই পান, তা হল – ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে কালো রংয়ের একধরনের কণিকা। দু’বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনি এই কালো কণিকাই যে একধরনের পরজীবী, তা আবিষ্কার করেন। ল্যাভেরনের আবিস্কার যে অসাড় ছিল না, তা প্রমাণিত হয় ১৮৯৯ খ্রি. অনুবীক্ষণ যন্ত্রে রক্তকণিকা পরীক্ষার পর। তবে ম্যালেরিয়া রোগকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্ত ছিল না। এক্ষেত্রে দুনিয়া জোড়া যাঁর নাম তিনি হলেন ডা: রোনাল্ড রস। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে কর্মরত ডা: রস বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছেন ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণা করার জন্য। তাঁর সাথে যুক্ত ছিলেন ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক নামে খ্যাত প্যাট্টিক ম্যানসন। শেষ পযন্ত ১৮৯৭ সালে ডা: রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন যে Anopheles (অ্যানোফিলিস) মশা এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে তাকে ১৯০২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
করেনা নিয়ে আজকার দিনে হাটে বাজারে, নানান মাহফিলে যে রকম রমরমা বক্তৃতা পাওয়া যায়। ম্যালেরিয়া নিয়েও উনিশ কিংবা বিশ শতকে সকল বাসরেই রমরমা বক্তৃতা পাওয়া যেত। প্রমথ চৌধুরীর লেখাতে পাচ্ছি সাহিত্য আসরেও ম্যালেরিয়া নিয়ে আলোচনা। তিনি যেমনটি লিখেছেন- “ প্রবীণ সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত অক্ষয় চন্দ্র সরকার মহাশয় সাহিত্যের আসরে মুখ খুললেই ম্যালেরিয়ার কথা তোলেন, – অমনি নবীন সাহিত্যিকদের দলে হাসির গর্ রা পড়ে যায়। এ হাসির কারণ কি,- তা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। ম্যালেরিয়া যে এদেশে আছে, এবং ও পাপ দূর না হলে দেশের যে মঙ্গল নেই- এ কথা এক পাগল ছাড়া আর কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।” মহামারী কিভাবে এলো? প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র রামায়ণে তার বিবরণ আছে। লেখাটি শেষ করব রামায়ণের বর্ণিত উপাখ্যান দিয়ে। হিমগিরির উত্তরে কর্কটী নামে এক ভয়ঙ্কর রাক্ষসী ছিল। এর আরো দুটি নাম ছিল বিসূচিকা ও অন্যায়বাধিকা। সবসময় তিনি ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকতেন। একদিন রাক্ষসী চিন্তা করল সমুদ্র যদি নদীগুলোকে গ্রাস করতে পারে, তাহলে আমিও জম্বুদ্বীপের সকল জন্তু জানোয়ার ভক্ষণ করলে ক্ষুধা কমে যাবে। এরূপ চিন্তা করে কর্কটী রাক্ষসী হাজার বছর ধরে তপস্যা শুরু করে। এরপর ভগবান ব্রক্ষ্মা কৃপাম্বিত হয়ে তাকে বর প্রদান করে। বরের মমার্থ হলো-“ তুমি অতি সূক্ষ্ম মায়া অবলম্বনপূর্বক কূভোজী কূকর্মরত কূদেশবাসী ব্যক্তিদিগকে সর্বদা হিংসা করিবে। তুমি বায়বীয় পরমাণুতূল্য হইয়া জীবের শ্বাস প্রশ্বাস অবলম্বনে তাহাদের আপন দেশ হইতে তাহাদের হ্নদয় পযন্ত আক্রমণ করিবে এবং হ্নৎপদ্ম সন্নিহিত প্লীহা যকৃৎ ও বস্তি শিরাদির পীড়া উৎপাদনপূর্বক তাহাদিগকে বিনাশ করিবে। তুমি বাত লেপাহিকা (বাত লক্ষণযুক্তা) বিসূচিকা ব্যাধি হইয়া গুণবান কিম্বা গুণহীন উভয় ব্যক্তিকেই আক্রমণ করিতে পারিবে।”
লেখক: উপ উপাচার্য, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।