ডিসেম্বর ২০১৯, পৃথিবীর ইতিহাসে চায়নাতে অদ্ভুত রকমের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ভাইরাসের উপদ্রব শুরু হয়। ফেব্রুয়ারি ২০২০ এসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসজনিত রোগটিকে COVID-19 (করোনা ভাইরাস ডিজিজ-১৯)নামে নামকরণ করে। অন্যদিকে একই দিনে আন্তর্জাতিক ভাইরাস শ্রেণীকরণ কমিশন ভাইরাসটির নাম দেয় severe acute respiratory syndrome coronavirus 2 (SARS-CoV-2)। এসব নামকরণের পিছনেও ইতিহাস আছে। গত দুই দশকে এই ভাইরাসের মতোই অন্য দুটি ভাইরাস যেমন severe acute respiratory syndrome (SARS) এবং Middle East respiratory syndrome (MERS) আক্রমণ করে। তবে তাদের তীব্রতা এতো বেশি ছিল না।
করোনা ভাইরাস চার রকমের যথা আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা। মানুষের মধ্যে আলফা করোনা ভাইরাস (HCoV-229E এবং NL63) এবং বিটা করোনা ভাইরাস (MERS-CoV, SARS-CoV, HCoV-OC43 and HCoV-HKU1)সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। যখন ডিসেম্বরে চায়নাতে নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগ ধরা পড়ে, তখন এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা যায় এটি বিটা করোনা ভাইরাস গোত্রের। এই ভাইরাসের ৮৮% জিনোমের সিকোয়েন্স বাদুড় থেকে আগত SARS-CoV ভাইরাসের (bat-SL-CoVZC45 এবং bat-SL-CoVZXC21) সাথে মিল রয়েছে। অপরদিকে ৫০% জিনোমের সিকোয়েন্স MERS-CoV ভাইরাসের সাথে মিল রয়েছে। এজন্যই এই অদ্ভুত ভাইরাসের নাম SARS-CoV-2 দেয়া হয়েছে। এই ভাইরাসের ব্যাসার্ধ ১০০-১৬০ ন্যানোমিটার। এটি একটি এনভেলপ আরএনএ ভাইরাস যাতে ধনাত্মক একসূত্রক আরএনএ (ssRNA) রয়েছে। জেনোমের সাইজ ২৬-৩২ হাজার বেজ। এই ভাইরাসটি আরএনএ গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাইরাস।
মনে রাখবেন, মানুষের জিনোম কোড ডিএনএ তে সংরক্ষিত। তাই আমাদের শরীরে ডিএনএ থেকে আরএনএ (ট্রান্সক্রিপশন) এবং আরএনএ থেকে প্রোটিন (ট্রান্সলেশন) তৈরি হয়, যেই প্রোটিনগুলো আমাদের শরীরের নানাবিধ কাজ করে। কিন্তু ভাইরাসের শরীরে আরএনএ থেকে মেসেঞ্জার আরএনএ এবং কমপ্লিমেন্টারি আরএনএ (ট্রান্সক্রিপশন), এরপর প্রোটিন তৈরি হয়। আমাদের শরীর ব্যবহার করে সে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে। সুতরাং আমাদের ট্রান্সক্রিপসন প্রক্রিয়া এবং ভাইরাসের ট্রান্সক্রিপসন প্রক্রিয়ার মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ভাইরাসের ট্রান্সক্রিপসন প্রক্রিয়াতে ব্যবহার হয় তাদের নিজস্ব রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম (RNA-dependent RNA polymerase)। মনে রাখুন এনজাইম নিজেও একটি প্রোটিন।
SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসের জেনোমে অন্তত ১০টি ওপেন রিডিং ফ্রেম (ORF) রয়েছে (নীচের ছবি দেখুন)। আরএনএ জেনোমের ৫’ দিকের দুই-তৃতীয়াংশতে রয়েছে প্রথম ওপেন রিডিং ফ্রেম (ORF1a/b) যা দুটি বড় প্রোটিন তৈরি করে, নাম পলিপ্রোটিন (pp1a এবং pp1ab) যেগুলো অন্ততপক্ষে ছোট ছোট ১৬টি ননস্ট্রাকচারাল প্রোটিনে (nsp1-nsp16) পরিবর্তিত হয়। বড় প্রোটিনগুলোকে ভেঙ্গে ছোট প্রোটিন তৈরির জন্য ভাইরাসের দুটি প্রোটিনেজ এনজাইম কাজ করে। প্রোটিন দুটির নাম হলো papain-like (SARS-PLpro) এবং Chymotrypsin-like folds (SARS-3CLpro)। দ্বিতীয় অর্থাৎ SARS-3CLpro এই এনজাইমটির নাম মনে রাখুন (পরবর্তীতে একে টার্গেট করে ওষুধের কথা বলা হবে)। অতএব ১৬টি প্রোটিনের কমপ্লেক্স দিয়ে তৈরি হয় ভাইরাসের রেপ্লিকেজ-ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্স আমাদের সুস্থ কোষের রাফ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে একধরনের গহব্বর তৈরি করে যেখানে পরবর্তী ধাপগুলো সম্পন্ন হয়।
অন্য ৯টি ওপেন রিডিং ফ্রেম (ORF) রয়েছে আরএনএ জেনমের একতৃতীয়াংশে। এখান থেকে তৈরি হয় চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাকচারাল প্রোটিন। এগুলো ভাইরাসের মূল শরীর গঠন করে। যেমন স্পাইক (S) প্রোটিন, এনভেলপ (E), নিউক্লিওক্যাপসিড এবং মেমব্রেন (M)। এছাড়া অন্যান্য প্রোটিনও তৈরি করে, যাদের কাজ এখনো অজানা। স্পাইক (S) প্রোটিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আমাদের শরীরের শ্বাসতন্ত্রের কোষের উপরিভাগের angiotensin-converting enzyme 2 (ACE2) প্রোটিনের সাথে সংযোগ ঘটায়। অর্থাৎ একটি ভাইরাসকে আমাদের সুস্থ কোষের ভিতর ঢুকতে স্পাইক (S) প্রোটিনটি সহায়তা করে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।