গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস জিএমপি GMP (Good Manufacturing Practice) হল এমন একটি নিয়মাবলী ও নির্দেশনার সেট যা ফার্মাসিউটিক্যাল, খাদ্য, ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনে গুণগত মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়। GMP নির্দেশিকা উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, এবং বিতরণে মানসম্মত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হ্রাস করে।
GMP গাইডলাইনের ইতিহাস:
১৯০৬: প্রথম খাদ্য ও ওষুধ আইন (Pure Food and Drug Act)
GMP-এর ইতিহাস শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০৬ সালে যখন Pure Food and Drug Act পাস হয়। এই আইন পণ্যের ভেজাল এবং ভুল লেবেলিং প্রতিরোধে কার্যকর করা হয়েছিল, যদিও এটি তখনও GMP-এর আদর্শ ধারণা প্রদান করেনি। তবে এটি স্বাস্থ্যকর পণ্যের নিশ্চয়তা দিতে একটি প্রথম পদক্ষেপ ছিল।
১৯৩৮: ফেডারেল ফুড, ড্রাগ এবং কসমেটিক অ্যাক্ট (Federal Food, Drug, and Cosmetic Act)
১৯৩৭ সালে “Elixir Sulfanilamide Disaster” নামে একটি বিপর্যয় ঘটে, যেখানে তরল ওষুধের ভেতর থাকা বিষাক্ত ডাইইথিলিন গ্লাইকোলের কারণে ১০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩৮ সালে Federal Food, Drug, and Cosmetic Act (FDCA) পাস করে, যা খাদ্য ও ওষুধের ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করে। এতে নির্দিষ্ট মান পূরণ না করা পণ্য বিক্রি করা নিষিদ্ধ হয়। এটি GMP গাইডলাইনের মূল ভিত্তি তৈরি করেছিল এবং সংস্থাগুলোকে ওষুধ এবং প্রসাধনী উৎপাদনের আগে FDA-এর কাছে নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার তথ্য প্রমাণ করতে বাধ্য করা হয়।
১৯৬২: Kefauver-Harris Amendment
১৯৬০-এর দশকে “Thalidomide Tragedy” নামে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। থ্যালিডোমাইড নামের একটি ওষুধ, যা গর্ভবতী নারীদের জন্য নিরাপদ বলে ধরা হয়েছিল, অনেক শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘটনার কারণে ১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে Kefauver-Harris Amendment পাস করা হয়। এই সংশোধনীতে ওষুধের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে আরও কঠোর নিয়মাবলী প্রণয়ন করা হয়।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে Good Manufacturing Practices (GMP) ধারণা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওষুধ নির্মাতাদের ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করতে আরও কঠোর নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজন ছিল।
১৯৬৩: প্রথম আনুষ্ঠানিক GMP প্রণয়ন
Kefauver-Harris Amendment এর পরেই ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে Good Manufacturing Practice (GMP) এর প্রথম আনুষ্ঠানিক নীতিমালা প্রকাশিত হয়। এই নীতিমালাগুলো মূলত ওষুধ প্রস্তুতকারকদের মান নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
এই প্রথম নীতিমালায় বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেমন, ওষুধ উৎপাদন প্রক্রিয়া, উপকরণের গুণগত মান, ল্যাবরেটরি কন্ট্রোল, প্যাকেজিং, এবং স্টোরেজ।
WHO GMP গাইডলাইন: ১৯৬৯
১৯৬৯ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আন্তর্জাতিকভাবে GMP প্রণয়ন করে, যা একটি গ্লোবাল মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। WHO-এর GMP গাইডলাইন বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মানসম্মত উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্ধারণে সহায়ক হয়েছিল।
WHO GMP নীতিমালা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মধ্যে ওষুধের গুণগত মান বজায় রাখতে সহায়তা করে।
EU GMP: ১৯৭১
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ১৯৭১ সালে GMP নীতিমালার একটি সংস্করণ চালু করে। ইউরোপীয় GMP গাইডলাইন আন্তর্জাতিক GMP-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয় এবং ওষুধ উৎপাদন ও পরীক্ষায় মানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মাবলী নির্ধারণ করে।
১৯৭৮: U.S. Code of Federal Regulations (CFR) – cGMP
১৯৭৮ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে FDA এর অধীনে Current Good Manufacturing Practice (cGMP) নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়। “Current” শব্দটি যোগ করার কারণ ছিল যে উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নতির সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বদা আপডেটেড প্রাকটিস এবং টেকনোলজি মেনে চলতে বাধ্য করা।
cGMP প্রয়োজনীয়তাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কাঁচামাল ব্যবস্থাপনা, সঠিক পদ্ধতিতে ডকুমেন্টেশন, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি, এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ।
ICH (International Council for Harmonisation): ১৯৯০-এর দশক
১৯৯০-এর দশকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য International Council for Harmonisation (ICH) তৈরি করা হয়। ICH-এর মাধ্যমে GMP মানদণ্ডগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে সংহত করার চেষ্টা করা হয় যাতে ওষুধের মান ও নিরাপত্তা গ্লোবালভাবে নিশ্চিত করা যায়।
ICH-এর মাধ্যমে GMP গাইডলাইনগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে গ্রহণযোগ্য হয় এবং বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি হয়।
GMP এর মূল উদ্দেশ্য:
গুণগত মান নিশ্চিতকরণ: উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং উপকরণ নিয়মিত মনিটরিং এবং কন্ট্রোলের মাধ্যমে গুণগত মান নিশ্চিত করা।
নিরাপত্তা বজায় রাখা: উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা, এবং কর্মচারীদের সুরক্ষা মানা।
ডকুমেন্টেশন: প্রতিটি ধাপের যথাযথ ডকুমেন্টেশন রাখা যাতে প্রয়োজনীয় সময়ে কোনো ত্রুটি বা সমস্যার উৎস সনাক্ত করা যায়।
ফলাফল পর্যবেক্ষণ: পণ্যের গুণগত ফলাফল যথাযথভাবে পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজন হলে উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ করা।
GMP গাইডলাইনের সার্বিক প্রভাব:
GMP নীতিমালা আন্তর্জাতিকভাবে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে মানদণ্ডের অন্যতম ভিত্তি। GMP না মেনে পণ্য উৎপাদন করলে তা বাজারজাত করার আগে বাতিল হতে পারে এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে পারে। GM- এর প্রবর্তনের পর থেকে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তা আরও ভালভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে, যা রোগীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বৃদ্ধিতে সহায়ক।