জাতির প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক

0

 দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম অবিশ্বাস্য রকম বেড়ে গেছে। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের ঘনঘন সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। এভাবে হাত পরিষ্কার না করে কোনোভাবেই চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করা যাবে না। প্রকৃতিগতভাবেই প্রায়ই চোখ-নাক-মুখ সুড়সুড় করে, জায়গাটা হালকা চুলকে দিলে স্বস্তি পাওয়া যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা দিনে অনেকবার চোখ-নাক-মুখ চুলকাই। কিন্তু এখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চুলকানোর আগে সাবান-পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০-৩০ সেকেন্ড সময়ব্যাপী দুই হাতের তালু ও পৃষ্ঠদেশ, আঙুলের ফাঁক ও নখের কোনা ইত্যাদি ভালো করে ঘষে ঘষে পরিষ্কার না করা পর্যন্ত এগুলো চুলকানো যাবে না। যে কোনো কিছু খাওয়ার আগেও একই নিয়ম। টাকা বা কাগজ গুনতে সুবিধার জন্য অনেকেই জিহ্বার পানি আঙুলে লাগান, কেউ কেউ নখ বা পেনসিল-কলম-দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচান, কেউ আবার দাঁতে নখ কাটেন। এর সবই অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বদভ্যাস। করোনার কারণে এখন তো এগুলো আরো নিষিদ্ধ।

সাবান ও পানি দিয়ে হাত পরিষ্কারের সময় সাবানটা দামি হতে হবে কিংবা কোনো একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের না হলে চলবে না, তা কিন্তু নয়। বরং কম দামি সাবান বা কাপড় ধোয়ার সাবান হলে আরো ভালো। কারণ কম দামি সাবানের ক্ষারত্ব বেশি এবং বেশি ক্ষারত্বের কারণে করোনা ভাইরাস আরো তাড়াতাড়ি মারা যায়। ক্ষারত্ব বেশির সাবান দিয়ে ঘনঘন হাত ধুলে হাতের ত্বক রুক্ষ ও খসখসে হয়ে যেতে পারে। তাই কাপড় কাচার বা বেশি ক্ষারত্বের সাবান পরিহার করাই ভালো।

তবে ভ্রমণের সময় কিংবা যখন সাবান ও পানি পাওয়া বা ব্যবহার সমস্যাজনক, সেখানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। এর কাজ সাবান-পানির মতোই। তবে এর অতিরিক্ত সুবিধা হলো অ্যালকোহল দিয়ে তৈরি হয় বলে এটি ব্যবহারের পর হাত মুছতে হয় না। অ্যালকোহল উদ্বায়ী বলে জীবাণু মেরে এটি হাত থেকে দ্রুত উড়ে যায়। অনেকেই তাই এই বিপদের দিনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে চান। স্বাভাবিক সময়ে যেটি খুব একটা বিক্রি হতো না, ফলে এর উত্পাদনও ছিল সীমিত। এখন ব্যাপকসংখ্যক মানুষ কিনতে চান বলে এর একটা ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। ফলে আমাদের ‘বুদ্ধিমান’ অসাধু ব্যবসায়ীরা এর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুণ। মানুষের দুর্ভোগের ‘সুযোগে’ এসব অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি আঙুল ফুলে শুধু কলাগাছ নয়, বরং বটগাছ হতে চায়।

কিন্তু যেসব উপাদান দিয়ে এটি তৈরি করা হয় তাতে এর দাম কোনোভাবেই এত বেশি হতে পারে না। অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফার উদগ্র লোভের কাছে মানুষ আজ একান্ত অসহায়। কিন্তু তাদের আগ্রাসি ও অমানবিক মুনাফার লোভের হাতে নিজেদেরকে অসহায়ের মতো সঁপে না দিয়ে আসুন এই হ্যান্ড স্যানিটাইজার আমরা নিজেরাই তৈরি করি।

যে কোনো দায়িত্ববান সংগঠন দেশের বর্তমান ক্রান্তিমুহূর্তে জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও মানুষকে সহযোগিতার মানবিক লক্ষ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি ও জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। অতীতে ঝড় ও মহাবন্যার মতো জাতীয় দুর্যোগে বিপুলসংখ্যক উত্সাহী তরুণ-তরুণীকে নিয়ে আমরা যেমন করে গণমানুষের, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর জন্য খাবার স্যালাইন, শিশুখাদ্য, চর্মরোগের মলম, রুটি ইত্যাদি স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তৈরি করেছি। এবারও অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগামহীন মুনাফার অমানবিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে গণহারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির সেরকম উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

যেসব সংগঠন জনস্বার্থে এরকম উদ্যোগ নেবে তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে কম খরচের একটি ফর্মুলা নিচে দেওয়া হলো। এর সবগুলো উপাদান আপনার শহরের কেমিক্যালের দোকান থেকে কেনা যাবে। ঢাকায় হাটখোলা বা মিটফোর্ড এলাকায় এরকম কেমিক্যালের অনেক দোকান আছে।

আইসোপ্রপাইল অ্যালকোহল (এটা না পাওয়া গেলে ইথাইল অ্যালকোহল বা ইথানল) — ৮০ মিলি।

গ্লিসারিন বা গ্লিসারল — ৫ মিলি।

সাইট্রাল (কিংবা লেমন অয়েল বা ইউক্যালিপটাস বা ক্লোভ বা সিনামন বা কারডামম অয়েল) — ৫ ফোঁটা।

পানি — ১৫ মিলি।

এগুলো একসঙ্গে সহজেই মেশানো যাবে এবং মেশালে মোট ১০০ মিলি হবে। মুখ সহজে টাইট করে বন্ধ করা যায়, এমন প্লাস্টিকের বা কাচের (কাচ সহজে ভেঙে যেতে পারে বলে প্লাস্টিকই ভালো) শিশিতে এটি ভরে দিতে হবে।

ইথাইল অ্যালকোহল বা ইথানল দিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করলে এটা দিয়ে ২০-৩০ সেকেন্ড ধরে হাত-আঙুল-নখ ঘষা যায় না। তার আগেই এটি দ্রুত বাতাসে উড়ে যায়। তাই আইসোপ্রপাইল অ্যালকোহল দিয়ে তৈরি করলে এটি দ্রুত উড়ে যাবে না, অথচ কার্যকারিতা একই। (আইসোপ্রপাইল অ্যালকোহলের আরেক নাম ‘রাবিং অ্যালকোহল’।)

প্রতি শিশিতে একটা লেবেল লাগাতে হবে যেখানে (১) সাশ্রয়ীভাবে প্রতিবার হাত পরিষ্কারের জন্য এই তরলটি আধা চা-চামচের বেশি প্রয়োজন নেই তা বলে দিতে হবে, (২) এই তরল হাতে নিয়ে হাত-আঙুুল-নখ ২০-৩০ সেকেন্ড ধরে ভালো করে ঘষতে হবে এবং (৩) এই তরল যেন কোনোভাবেই মুখে না যায়—এই তথ্য উল্লেখ করতে হবে।

লেবেলে উত্পাদনকারী সংগঠনের নাম-ঠিকানা ও ‘জনস্বার্থে’ উত্পাদিত তা উল্লেখ করতে হবে।

এই হ্যান্ড স্যানিটাইজার কাউকে এক শিশির বেশি দেওয়া ঠিক হবে না। অনেককে যাতে এই শিশি দেওয়া যায় তার জন্য বিনা মূল্যের পরিবর্তে প্রতি শিশি তৈরিতে কাঁচামালের দাম হিসেবে ২০ বা ২৫ টাকা নেওয়া উচিত হবে।

যেহেতু এর মূল উপাদান অ্যালকোহল অত্যন্ত দাহ্য, তাই উত্পাদন এলাকায় কোনো আগুনের শিখা বা ফুলকির বিরুদ্ধে পুরো সাবধানতা নিতে হবে। আর উত্পাদন এলাকায় ও আশপাশে ধূমপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকবে।

যাদের ড্রাই স্কিনের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির সময় গ্লিসারিনের পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে।

ইতিমধ্যেই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার থেকে উদ্যোগ নিয়ে আমাদের কেন্দ্রের গবেষকবৃন্দ এবং ফার্মেসি অনুষদভুক্ত শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীবৃন্দ এটির উত্পাদন শুরু করেছি। দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে-যেখানে ফার্মেসি পড়ানো হয় তাদেরকেও আমরা আহ্বান জানিয়েছি এর উত্পাদন শুরুর জন্য। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন সংগঠন, যারা এটি সেবামূলক কাজের অংশ হিসেবে উত্পাদন করতে চান, তাদেরকে আমরা প্রযুক্তিগত পরামর্শ দিতে প্রস্তুত রয়েছি। তবে এটি নিয়ে কোনো ব্যাবসায়িক উদ্যোগকে আমরা সহায়তা করব না।

করোনা ভাইরাস আর অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, আমরা সবাই একসঙ্গে।

লেখক :পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[ইত্তেফাক অবলম্বনে]
মতামত দিন
Loading...