করোনা ভাইরাস ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা
জনি মল্লিক
কভিড-১৯, বর্তমান বিশ্বের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বদলে দেওয়া একটি সংক্রামক রোগের নাম। এই রোগটি নভেল করোনাভাইরাস (সার্চ-সিওভি-২) নামক এক আবরণধারী ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। করোনাভাইরাস তার বহিরাবরণ ও অভ্যন্তরীণ গঠনের কারনে অনেকটাই শক্তিশালী ভাইরাস। প্রতিলিপি গঠনের মধ্যদিয়ে করোনাভাইরাস মানবশরীরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে।
মানুষের শরীরে প্রবেশের পথ হলো নাক, মুখ ও চোখ। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, এমনকি কথা বলার সময় নির্গত ড্রপলেটের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। সারাবিশ্ব একপ্রকার তোলপাড় শধু একটি উপায় বের করার জন্যে। যে উপায়ে করোনাভাইরাস নির্মূল সম্ভব। যদিও এখন পর্যন্ত বেশকিছু বিদ্যমান ও নতুন ড্রাগের ট্রায়াল হয়েছে ও হচ্ছে৷ কিন্তু সেই অর্থে কার্যকর কোন ড্রাগের সন্ধান পাওয়া যায়নি। নেই কোন কার্যকর ভ্যাক্সিন।
তাহলে কি করে করোনা মোকাবেলা হবে? কখন যাবে এই করেনা ভাইরাস? এটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। এমন প্রশ্নের উত্তর হতে পারে মানবশরীরের নিজস্ব এক সিস্টেম। যার নাম ইমিউনো সিস্টেম। ইমিউনো সিস্টেমের সক্ষমতাকে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি বলে। কোন অণুজীব আমাদের শরীরে প্রবেশের চেষ্টা করলে ইমিউনো সিস্টেম সক্রিয় হয়ে যায় ও নিজস্ব প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মানবশরীরের ইমিউনিটি হতে পারে সহজাত ও অর্জিত। সহজাত প্রতিরক্ষা হলো যা আমরা জন্মলগ্ন থেকে বহন করছি এবং যা সাধারণত পরিবর্তনের সুযোগ নেই। সহজাত প্রতিরক্ষা যেকোন সংক্রমণের শুরুর দিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
অর্জিত প্রতিরক্ষা হলো যা আমরা আমাদের জীবনপ্রণালীর মধ্যে দিয়ে অর্জন করি এবং যার পরিবর্তনের উপর আমাদের হাত আছে। ইমিউনো কোষ হলো প্রতিরক্ষার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। মানবশরীরের রক্তের সাথে প্রবাহমান কোষ গুলোর মধ্যে লিম্ফোসাইট, ফ্যাগোসাইট ও ম্যাক্রোফেইজ উল্লেখযোগ্য অংশে রোগ প্রতিরোধ ভূমিকা রাখে।
এছাড়া টি-সেল ও বি-সেলের সম্মিলিত প্রতিরোধে আমরা প্রায় অনেক অণুজীবকে ঠেকিয়ে দিচ্ছি। যেহেতু এখনো করোনাভাইরাসকে রুখে দেওয়ার মতো কোন ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি তাই ইমিউনিটি এই মূহুর্তে ভ্যাক্সিনের কাজটি করার ক্ষমতা রাখে। এখানে বলে রাখা ভালো যে ঠিক কোন পথে আমাদের ইমিউনিটি করোনাভাইরাসকে রুখে দেয় তার পুর্নাঙ্গ বর্ননা এখনোও পাওয়া যায়নি।
তবে ২০০৩ সালের সার্চ প্রাদুর্ভাবে দেখা গিয়েছিল যে আক্রান্ত কোষ-নিঃসৃত ইন্টারফেরনের মাত্রা কমে যাওয়ায় প্রতিরক্ষা কোষের কার্যক্ষমতা কমে গিয়েছিলো। মানুষ যখন কোন ভাইরাসের কারণে সংক্রামিত হয়, এবং ভাইরাস কোষের ভিতরে প্রবেশ করে নিজেই কোষীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারনত করোনাভাইরাস প্রবেশের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আমাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরি শুরু হয়।
এন্টিবডি হলো এমন কিছু প্রোটিন যা কোন এন্টিজেনের উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে তৈরি হয়। ১৪ মে, ২০২০ একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় কভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরে সিডি ৪ ও সিডি ৮ টি-সেল পাওয়া গিয়েছে এবং এই টি-সেল এন্টিবডি তৈরিতে অংশ নিয়েছে। এখান থেকে প্রমাণিত যে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে।
যখন আমরা জানি, আমাদের হাতে কোন ঔষধ বা ভ্যাক্সিন নেই তখন নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় হতে পারে একমাত্র ভরসার নাম। উল্লেখ্য, সবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিন্তু একরকম নয়। তাই এই প্রতিরোধ ক্ষমতাকে একধাপ বাড়ানোই আমাদের কাজ হওয়া উচিত।
এখন প্রশ্ন হলে কিভাবে এটি করা যেতে পারে?
১/ পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা।
২/ পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো। (অনিদ্রা ইন্টারফেরনের মাত্রা কমিয়ে দেয়)
৩/ ভিটামিন সি ও ডি যুক্ত খাবার খাওয়া।
৪/ ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করা।
৫/ ফলমূল ও শাকসবজি খাদ্য তালিকায় রাখা।
৬/ নিয়মিত হালকা ব্যয়াম করা ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এবিষয় গুলো সম্মিলিত ভাবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এগিয়ে রাখে। ইমিউনো কোষ গুলোর মধ্যকার সমন্বয় থাকলে যে কোন অণুজীবের প্রতিলিপি গঠনের চেষ্টাকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। এই সমন্বয় তখনই সম্ভব যখন প্রতিরোধ ব্যবস্থা উন্নত থাকে। পরিশেষে বলা যায়, করোনাভাইরাসে প্রতিরোধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই এখন পর্যন্ত এগিয়ে। এখন এই কভিড-১৯ সময়কালে আমাদের করনীয় হলো সর্বোচ্চ সচেতন থাকা ও নিজেদেরকে করোনাভাইরাসের বিপক্ষে ইমিউন করা ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া।
লেখকঃ ফার্মাসিস্ট , মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ,পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড।