বহুকাল পুরোনো এক রুপকথা। অন্ডাইন নামক এক জলদেবী ছিলো ফরাসি রুপকথায় কোনো এক সময়ে।লরেন্স নামক এক সুপুরুষ যোদ্ধা রোজ বাড়ির সামনে দিয়ে হেটেঁ যেতো জলদেবীর।লরেন্সের আকর্ষনীয় শারীরিক গঠন দেখে প্রবলভাবে আসক্ত হয়ে পরে জলদেবী। সময় যত গড়ায় আকাক্ষা ক্রমশই বাড়তে থাকে। এদিকে লরেন্স বার্টা নামক এক সভ্রান্ত যুবতীর বাগদওা ছিলো। কিন্তু দেবীর অতিরিক্ত আগ্রহ দেখে লরেন্স একটা সময় এসে হার মানে।
দেবী ছিলো অমর,মর্ত্যলোকের কাউকে বিয়ে করলে দেবীত্ব হারাতে হবে জেনেও ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ করে লরেন্সকে বিয়ে করে। বিয়ে করার সময় লরেন্স প্রতিজ্ঞা করে,”আমার জেগে থাকা প্রতিটা নিঃশ্বাস হবে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার।”মর্ত্যলোকের আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো দেবীর সৌন্দর্য একটাসময় এসে কমতে থাকে। অকৃতজ্ঞ লরেন্স ফলে পুরনো বাগদওা বার্টার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়।
কোনো এক দুপুরে অন্ডাইন আবিষ্কার করে লরেন্স খড়ের গাদায় বার্টার বাহুতে ঘুমিয়ে আছে। ভালোবাসায় তীব্র আঘাত পেয়ে অন্ডাইন অভিশাপ দিয়ে বলে ওঠে,” তুমি আমার প্রতি বিশ্বস্ততার কসম করে ছিলে তোমার প্রতিটি জাগ্রত নিশ্বাসের উপর,আমি তোমার প্রতিজ্ঞা গ্রহন করলাম। ঠিক তাই হোক তুমি যা প্রতিজ্ঞা করেছিলে। তুমি যতক্ষণ জাগ্রত থাকবে, নিঃশ্বাস নিবে কিন্তু তুমি যদি ঘুমিয়ে পরো তোমার নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
অকৃতজ্ঞ লরেন্স একসময় নিজ ইচ্ছায় শ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায় ও ফলে মারা যায়।মেডিকেলিয় ভাষায় এই রোগকে অন্ডাইন কার্স বা অন্ডাইনের অভিশাপ বলা হয় যা অন্তত বিরল রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়।
দিল্লির সেন্ট্রাল হাসপাতালে হটাৎ একদিন প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে মুয়াজ আহমেদ নামে তিন বছর বয়সী এক বাচ্চা ভর্তি হয়। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করার পর নিশ্চিত হয় মুয়াক সেই ১৫ হাজার মানুষের মধ্যে অন্যতম যারা বিরল এই রোগ নিয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেয়। মূলত এই রোগের ক্ষেত্রে রোগী নিজ থেকে শ্বাস নিতে পারে না। রাতের বেলা অক্সিজেন ছাড়া কোনোভাবেই বেচেঁ থাকা সম্ভব না।
কোনো হয় এই রোগ?
আমাদের মতিষ্কের যে অংশটির জিনের কারনে আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারি, সেটার অনুপস্থিতির কারনে এই রোগ হয়ে থাকে। যার ফলে রোগী রাতে কোনোভাবেই ঘুমিয়ে পড়লে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে না, ফলে মারা যায়। প্রশ্ন আসে তাহলে কিভাবে বেঁচে থাকে এরা?
এই রোগের রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য আজীবন যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকতে হয়। তবে এটার একটা সমস্যাও আছে। এই পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে ট্রাকিয়োটমি (Tracheotomy) করতে হয়। এটি এক ধরনের সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া। তবে অধুনা বাইফেসিক কুইরাস ভেন্টিলেশন (Biphasic Cuirass Ventilation) নামে আরেকটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে যেখানে এই ট্রাকিয়োটমি করতে হয় না। 7 এছাড়াও ফ্রেনিক নার্ভ পেসিং (Phrenic Nerve Pacing) নামে আরেকটি পদ্ধতি আছে। 8 তবে এই সমস্ত প্রক্রিয়াই অনেক ব্যয়বহুল যা বহু সাধারণ্যের নাগালের বাইরে থেকে যায়। অনেক গবেষক কি মনে করেন জানেন? অনেক শিশুই হয়তো এই ওন্ডিস কার্সের কারণেই মারা যায় যাদের আমরা হঠাৎ শিশুমৃত্যু (sudden infant death syndrome বা SIDS) হিসেবে অন্য খাতে ফেলে দিই।
প্রতিদিন ৩-৪ টা অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগার পরও মুয়াজ অন্যসব বাচ্চাদের মতো হেসে খেলে বেড়ায়;এতো সংগ্রামের পরও জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে চায় এমন হাজারোও মুয়াজ। আমরা আশা রাখি, কোনোএকদিন বিজ্ঞান এদের এই সমস্যার একটি কার্যকরী সমাধান দিয়ে অন্য সবার মতো এরাও রাতে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ,বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়।