ডেক্সামিথাসন হলো এক প্রকার কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন যা ১৯৫৭ সালে প্রথম সংশ্লেষণ করা হয়। এই সংশ্লেষিত যৌগটি কার্বন, হাইড্রোজেন, ফ্লোরিন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে গঠিত। যৌগটি ১৯৬১ সালে মানবদেহে চিকিৎসার জন্য প্রথম ব্যবহার শুরু করা হয়। অ্যাজমা, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যালার্জি, ত্বকের সংক্রমণসহ বেশ কিছু রোগে ওষুধটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় থাকা ডেক্সামিথাসনের মূল্যও অন্যান্য ওষুধের তুলনায় অত্যন্ত কম। এই জনপ্রিয় ওষুধটি নিয়েই কোভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে গবেষণা চালিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধানী দল।
অক্সফোর্ডের গবেষকদল ডেক্সামিথাসনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি শুরু করেছিলো গত মার্চ মাসে। তারা ব্যাপকভাবে চালানো সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছেন ১৬ জুন। প্রকাশিত ফলে তারা দাবি করেছেন, কোভিড-১৯ রোগে এই প্রথম আমরা জীবন রক্ষাকারী কোনো ওষুধ পেতে যাচ্ছি। গবেষকদলটি ৪৪২৫ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা ২০১৪ জন করোনা রোগীকে ডেক্সামিথাসন প্রয়োগ করে চিকিৎসা দিয়েছেন এবং আরও ২৩২১ জন রোগীকে এই ওষুধটি ছাড়াই চিকিৎসা দিয়েছেন। দীর্ঘ ২৮ দিন প্রত্যেকটি রোগীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পর চমৎকার ফল পেয়েছেন তারা। তাদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রবল সংক্রমণে ভেন্টিলেটর নিতে হয়েছে এমন করোনা রোগীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক চিকিৎসাপ্রাপ্তদের মৃত্যুর হার যেখানে ৪০%, সেখানে ডেক্সামিথাসন গ্রহণকারীদের মৃত্যুর হার ২৮%। আবার যেসকল রোগীদের অক্সিজেন সেবা নিতে হয়েছে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিক রোগীদের মৃত্যুহার ২৫%; অথচ ডেক্সামিথাসনের মাধ্যমে চিকিৎসাপ্রাপ্তদের মৃত্যুর হার ২০%। অর্থাৎ ডেক্সামিথাসন ওষুধটি ভেন্টিলেটর গ্রহণকারী করোনা রোগীদের মৃত্যুর হার ১২% পর্যন্ত কমিয়ে আনতে সক্ষম এবং কেবল অক্সিজেন ব্যবহারকারী রোগীদের মৃত্যুর হার ৫% হ্রাসে কার্যকরী। এ বিষয়ে গবেষকদলটির প্রধান অধ্যাপক মার্টিন ল্যানড্রে জানিয়েছেন, যাদের ভেন্টিলেটর প্রয়োজন তাদের প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু কমাতে পারবে ডেক্সামিথাসন এবং অক্সিজেন সুবিধা নেয়া রোগীদের প্রতি ২০-২৫ জনের মধ্যে ১ জনকে বেশি বাঁচাতে পারবে ওষুধটি। অর্থাৎ করোনার সংক্রমণ যত বেশি তীব্র হবে, ডেক্সামিথাসন ওষুধটি হবে তত বেশি কার্যকরী।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটিতে করোনা রোগীদের প্রথম ২০১৪ জনের গ্রুপকে ৬ মিলিগ্রাম করে ডেক্সামিথাসন ১০ দিন পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে মৃদুভাবে সংক্রমিত করোনা রোগীর দেহে ওষুধটির কোনো কার্যকারিতা পাওয়া যায় নি। তবে সংক্রমণ তীব্র হয়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়া রোগীদের মধ্যে ওষুধটির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত করোনা চিকিৎসার জন্য আলোচিত একটি মাত্র ওষুধ রেমডেসিভির। এটি কেবলমাত্র ইমার্জেন্সি রোগীদের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন। কিন্তু সেই ওষুধটিও মৃত্যু কমাতে কার্যকর নয়। তাই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চালানো গবেষণার প্রধান পর্যবেক্ষক অধ্যাপক পিটার হর্বি বলেছেন, “করোনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত মৃত্যুঝুকি কমাতে পারে, এমন ওষুধ হিসেবে একমাত্র ডেক্সামিথাসনকেই দেখা যাচ্ছে। এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি”।
রোগীর দেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্দীপিত হয় এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এতে করে শতকরা ৯২ থেকে ৯৫% রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হয়েই সুস্থ হয়ে উঠছেন। বাকি রোগীদের প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন ও ভেন্টিলেটর সুবিধা নেয়া জরুরী হয়ে পড়ে। ঠিক এমন সংকটাপন্ন রোগীর জন্যই কাজ করবে ডেক্সামিথাসন। আসলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন যুদ্ধ করে, তখন কোষ থেকে সাইটোকাইন নামক এক প্রকার প্রোটিন ক্ষরিত হয়। কিন্তু এই প্রোটিন অতিরিক্ত হারে ক্ষরণ হওয়া শুরু হলে তাকে সাইটোকাইন স্টোর্ম বলে। সাইটোকাইনের অতিরিক্ত ক্ষরণ রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ডেক্সামিথাসন এই সাইটোকাইন স্টোর্মের বিরুদ্ধে কাজ করে মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
গণমাধ্যমে ডেক্সামিথাসনের সফলতার খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। ওষুধটি আমাদের দেশের ওষুধের দোকানগুলোতে বেশ সস্তায় কেনা যাবে। এতে করে বেশ কিছু সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। যেমন, কিছু করোনা রোগী নিজে নিজেই ডেক্সামিথাসন ট্যাবলেট কিনে নিয়ে সেবন করা শুরু করতে পারেন। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, মৃদুভাবে করোনায় সংক্রমিত রোগীর দেহে ডেক্সামিথাসন কোনো কাজই করবে না। বরং তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাই কেবলমাত্র ডাক্তারগণই ওষুধটি প্রেসক্রাইব করতে পারবেন এবং সেটাও প্রবল শ্বাসকষ্টে ভোগা করোনা রোগীর ক্ষেত্রে।
ডেক্সামিথাসন আবার বেশ কিছু ওষুধের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে। যেমন, এরিথ্রোমাইসিন ওষুধের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় রোগীর দেহে ডেক্সামিথাসনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে করে শরীরে পার্শপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এ ধরণের মিথস্ক্রিয়া বিবেচনা করেই রোগীর জন্য ডেক্সামিথাসনের ডোজ ঠিক করতে হবে।
করোনায় আক্রান্ত রোগীর দেহে আরও কিছু রোগ থাকলে ডেক্সামিথাসন ব্যবহারে ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগের উদাহরণ দেয়া যায়। ডায়াবেটিস রোগী করোনায় সংক্রমিত হলে এবং তার চিকিৎসায় ডেক্সামিথাসন ব্যবহার করলে রোগীর দেহে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে করে ডায়াবেটিস লেভেল বেড়ে গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। তাই ডাক্তারকে কোভিড-১৯ রোগীর শরীরে অন্যান্য রোগের উপস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই ডেক্সামিথাসনের চিকিৎসা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্তত ডোজিংয়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার হবে।
শেষকথা হলো, করোনা চিকিৎসায় ডেক্সামিথাসন কিছুটা আশার আলো হিসেবে আবির্ভূত হলেও তা সকল রোগীর জন্য কার্যকরী নয়। কেবল হাসপাতালে ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন সুবিধা নিতে হচ্ছে, এমন রোগীর জন্যই ডেক্সামিথাসন ব্যবহার করতে হবে। এবং ডাক্তারদের নির্দেশনা অনুসারেই তা প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের দেশের কোনো করোনা রোগী এবং তার পরিবারের কেউ যেন অযথাই ফার্মেসির দোকানে গিয়ে ডেক্সামিথাসন কিনতে ভীড় না করেন-এমনটিই এখন প্রত্যাশা করবো।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।