থ্যালিডোমাইড ট্রাজেডি

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময় মানুষ নিদ্রাহীনতা সহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে । এজন্য তারা বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ঔষধ ও ট্রাঙ্ককুইলাইজার (ট্রান্সকুইলাইজার হচ্ছে এমন শ্রেণির ঔষধ যা উদ্বেগ, ভয়, মানসিক অশান্তি জনিত সমস্যা কমাতে ব্যাবহার করা হয়।) জাতীয় ঔষধ ব্যাবহার করত । তখন থ্যালিডোমাইড বাজারে ঘুমের ঔষধ/ ট্রান্সকুইলাইজার হিসেবে চালানো হচ্ছিল ।

১৯৫৭ সালে থ্যালিডোমাইড (Thalidomide) প্রথম বাজারজাতকরণের পরে বিভিন্ন রোগীর অনুমোদনকৃত লক্ষণে থ্যালিডোমাইড প্রচুর পরিমানে ব্যবহার করা হতো। এমন কি থ্যালিডোমাইড গর্ভাবস্থায়ও ব্যবহার করা যাবে এমন নির্দেশনাও ছিল। চিকিৎসকরা ঔষধ টি সন্তানসম্ভবা মায়েদের ক্ষেত্রেও ব্যবহারের জন্য প্রেসক্রিপশন করতেন৷ কিন্তু তখনো এরকম কোন সঠিক জোড়ালো তথ্য ছিল না যে ঔষধটি গর্ভাবস্থায় নিরাপদ।

থ্যালিডোমাইডের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ফোকোমেলিয়া নিয়ে জন্ম নেয়া এক মেয়ে শিশু ।

ঔষধটির উৎপাদনকারীদের সুরক্ষা দাবির উপর ভিত্তি করে থ্যালিডোমাইড ১৯৫৭ সালে একটি ওভার-দ্য কাউন্টার ড্রাগ হিসাবে প্রথম পশ্চিম জার্মানিতে বিপনন শুরু হয় । তারা তাদের পণ্যটি “গর্ভাবস্থা” সহ প্রত্যেকের জন্য “সম্পূর্ণ নিরাপদ” হিসাবে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। নিরাপদ বিবেচনায় ১৯৬০ সালের মধ্যে ৪৬ টি দেশে থ্যালিডোমাইড বিক্রি ও বিপনন শুরু হয়ে যায়।

এই সময়ে, অস্ট্রেলিয়ান প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডাঃ উইলিয়াম ম্যাকব্রাইড তার রোগীদের উপর ঔষধ টি প্রয়োগ করতে থাকেন এবং তাদের পর্যবেক্ষনে রাখেন। ১৯৬১ তে , ম্যাকব্রাইড তাঁর ডেলিভারি করা বাচ্চাদের গুরুতর জন্মগত ত্রুটি দেখতে পান। এসময় তিনি শিশুদের এই জন্মগতত্রুটির সাথে এই তথাকথিত নিরাপদ ঔষধটির সম্পর্ক খুঁজতে শুরু করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন ওষুধটি ভ্রনের স্বাভাবিক বিকাশে বাধাদেয়, যার ফলে অনেক শিশু ফোকোমেলিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যার ফলস্বরূপ ছোট অঙ্গ প্রতঙ্গ, অঙ্গহীন শিশুর জন্ম হতে দেখা যায় ।

থ্যালিডোমাইডের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ফোকোমেলিয়া নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুরা ।

 

ততদিনে জার্মানির একটি সংবাদপত্র কোন এক প্রাথমিক গবেষণা র উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে বলা হয় যে থ্যালিডোমাইড এর জন্য ১৬১ শিশুর উপর ঔষধটির বিরুপ প্রভাব পড়েছে। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী ব্যপক আলোড়ন তৈরী করে৷

অবশেষে ঔষধটির উৎপাদনকারীরা জার্মানিতে থ্যালিডোমাইড বিপনণ বন্ধ করে দেয়। অন্যান্য দেশগুলিও একই পথ অনুসরণ করে এবং ১৯৬২ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বেশিরভাগ দেশে এই ঔষধ বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়৷

Thalidomide-এর ব্যবহার করার কারণে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ৪৬টি দেশ থেকে ১০,০০০ এরও বেশী বিকৃত শিশুর জন্ম হয়।
     এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালে WHO আন্তর্জাতিক ঔষধ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম চালু করে। এই ঘটনা বিশ্ব ব্যাপি ফার্মাকোভিজিলেন্স কে নতুন মাত্রা দেয়৷

১৯৭৮ সাল থেকে উপসালা মনিটরিং সেন্টার (ইউএমসি) এর মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৫০টির বেশী দেশে ফার্মাকোভিজিলেন্স নেটওয়ার্ক গঠন করেছে যা WHO-এর আন্তর্জাতিক ঔষধ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি নামে পরিচিত।
সাধারণত ঔষধের গুণগতমান, অপর্যাপ্ত মাত্রায় ঔষধ গ্রহণ কিংবা যথেচ্ছ ব্যবহার ইত্যাদির ফলে মানবদেহে সংঘটিত যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় সেগুলো সবই Adverse Drug Event (ADE) এর অন্তর্ভুক্ত।

জার্মান চিত্র নির্মাতা নিকো ভন গ্লাসো । যিনি থ্যালিডোমাইডের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার । ছবি: গেটি ইমেজ ।

থ্যালিডোমাইড ট্রাজেডি ঔষধ বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা৷ এটি Adverse Drug Event বা ঔষধের বিরূপ ঘটনার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

[হেলিক্স অবলম্বনে] 

আন্তর্জাতিক ঔষধ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচিথ্যালিডোমাইড ট্রাজেডিফার্মাকোভিজিলেন্স
Comments (০)
Add Comment