বিবেক যখন করোনা আক্রান্ত !

মনোজিৎ কুমার রায়

0

বাংলাদেশ করোনার রাজত্ব প্রায় চার মাস হতে যাচ্ছে। এই কয়েক মাসে করোনা আমাদের যা শেখালো, তা হয়তো কয়েকশ বছরেও আমরা শিখতে পারিনি। করোনার প্রভাব কোথায় পড়েনি। সামাজিক-মানবিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিকভাবে অতঃপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে এই করোনা।এর আগে ও তো অনেক ভাইরাসের তান্ডব-লীলা চলেছে।কই এতটা তো আমরা ঘাবড়ে যাই নি।তবে কিসের এত ভয়!নিজের মৃত্যু ভয় না কি পরিবার স্বজনের তাড়না? বুঝা বড় দায়।

জীবাণুর বংশ বৃদ্ধি তখনি ঘটে যখন আমাদের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি হয়।সরকারী-বেসরকারীভাবে অনেকবার এই ব্যাপারে সতর্ক করলেও আমরা খুব কম মানুষই তা কর্ণপাত করতাম।কয়জনই বা আমরা হ্যান্ডস্যানিটাইজার চিনতাম। করোনা আমাদের চিনিয়েছে,আমাদের ব্যাবহার করতে বাধ্য করিয়েছে। কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত ধৌত করার কথা তো আর নতুন নয়।কয়জনই বা আমরা খাবার খাওয়ার আগে হাত সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহার করতাম।শুধুমাত্র পানি দিয়ে হাত কোন মতে ধুয়ে খাবার খেয়ে নিতাম।পানি কি জীবাণু মারতে পারে?শুধু মাত্র হাতের উপরিভাগের ময়লা পরিস্কার করতে পারে।জীবাণু মারতে দরকার জীবাণুনাশক, যা কিনা সাবান পানি বা হ্যান্ডস্যানিটাইজার/হ্যান্ডওয়াশ এর মাধ্যমে সম্ভব।করোনা আসাতে আমাদের এসব বিষয়ে মোটামুটি সম্যক ধারনা হয়ে গেছে।ফার্মেসিতে আগে যেখানে মাসের পর মা সহ্যান্ডস্যানিটাইজার/হ্যান্ডওয়াশ পড়ে থাকতো,সেখানে এখন অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া দুস্কর,বিশেষ করে নামিদামি কোম্পানীগুলোর।যা দেখা যায় না, বুঝা যায় না তার কি তেলেসমাতি!

করোনা আমাদের সামাজিকতায় আমুল পরিবর্তন এনেছে।এক সময়  ঘরের বাইরে থাকা মানুষদের ঘরে থাকার অভ্যাস শিখিয়েছে। লকডাউন সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রিয়তম জননী কিংবা অর্ধাঙ্গিনী যে কিনা সারাদিন ঘর সামলিয়ে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর, তাদের অবদানটুকু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের ঘরে বসে থাকায়।পরিবার-পরিজনের সাথে এক সাথে থাকায় অনেক আন্তরিকতা বাড়িয়েছে।কর্মের জন্য যাদের বাইরে থাকতে হয়, তাদের জন্য কিছুটা সুযোগ দিয়েছিল মা-বাবার সাথে একত্রে থাকার। করোনা কিনা শিখিয়েছে!

একটু বিবেকের ভিতরে যাই। করোনা আমাদের মানবিকতায় দারুন আঘাত হেনেছে।যে মা-বাবার জন্য আমাদের এই ধরনীতে আসা,যাদের জন্য আজ এই করোনায় ভয় কিংবা জয়,তাদেরকে ছুড়ে ফেলে দিতেও কম দেখা যায়নি। মৃত মা –বাবার শেষ কাজটুকু করতেও তারা অপরাগতা জানিয়েছে। করোনা জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, মানবতা –সামাজিকতা অনেকের কাছে শুধুমাত্রই ব্যাক্তি কেন্দ্রিক।সন্তান করোনা আক্রান্ত হলে কোন মা-বাবা ফেলে গেছে কিনা এই হিসাব পাওয়া দুস্কর।তবে কি জীবন শুধুমাত্র সন্তানকেন্দ্রিক! উত্তর পাওয়া কঠিনতম কাজ।

নকল হ্যান্ডস্যানিটাইজার,হ্যান্ডওয়া্‌শ-মাস্ক এ বাজার সয়লাব।ভুয়া করোনা এবং সার্টিফিকেট রিপোর্ট দিয়ে আজ অনেকই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।এক দিকে কারোও অর্থ আয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে ,আবার অনেকের পোয়াবারো।একদিকে ডাক্তার এবং প্রশাসন জীবনবাজি রেখে আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে আমরা বাইরে ঘুরে ঘুরে লকডাউনের জন্য চিৎকার করে যাচ্ছি।একদিকে ঔষধ কোম্পানির করোনাযোদ্ধারা দিন –রাত কাজ করে ঔষধের চাহিদা মেটাচ্ছে, অপরদিকে কেউ কেউ ঔষধ এবং করোনা সুরক্ষাসামগ্রী্র দাম বাড়িয়ে সাধারন মানুষকে হয়রানি করছে। করোনা শিক্ষাচ্ছে বটে!

ভ্যাক্সিন অবশ্যই আসবে।হয়তো আবার আমরা ফিরে পাবো সোনালী সেই দিনগুলো। কিন্তু করোনাকালে আমাদের যে মানবিকতা-সামাজিকতার মৃত্যু হচ্ছে তা কোন ভ্যাক্সিনে সারবে সেটা বলা মুশকিল।সামাজিক দূরত্ব ছয় ফুট বজায় রাখলেও কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা মানবিক দূরত্ব কয়েক শ ফুট বজায় রাখছি।যদিও এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা/আইন নেই, তাই হয়তো খুবসহজেই এড়িয়ে যেতে পারি।তবে সামনের দিনে যে করোনা আরোও অনেক কিছু শিখিয়ে দিবে, সেটা ঢের বুঝা যাচ্ছে।

জয় হোক মানবতার।

লেখক: মাইক্রোবায়োলোজিষ্ট

 

 

মতামত দিন
Loading...