করোনা ভাইরাসের মলিকিউলার দৃষ্টিভঙ্গি: পর্ব ৩

মোঃ আব্দুল মুহিত

0

স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনঃ ভ্যাকসিন কিংবা অ্যান্টিবডি তৈরি কি অসম্ভব?

এখনকার SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনে ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটের পাশাপাশি নতুন করে আরো চারটি অ্যামাইনো এসিড (এসপেরাজিন, সেরিন, প্রোলিন, আরজেনিন) এসে যুক্ত হয়েছে, যা এই সিরিজের অন্য ভাইরাসে নেই। ফলে পলিবেসিক একটা চরিত্র এসে গেছে যার কারনে এটি মারাত্মকভাবে মানুষে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পরে এর S1/S2 সাবইউনিটের সংযোগস্থলে প্রথমে ভাঙ্গন হয়। (S1) সাবইউনিটটি মানবদেহের শ্বাসতন্ত্রের (ACE2) প্রোটিনটির সাথে যুক্ত হয়। বিভিন্ন করোনা ভাইরাসের (S1) সাবইউনিটের মোট দুটি ডোমেইনের [S domain A (SA) এবং S domain B (SB)] মাধ্যমে তার টার্গেট রিসেপ্টরে যুক্ত হয়। এখনকার SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসটি S domain B (SB) এর মাধ্যমে (ACE2) প্রোটিনটির সাথে যুক্ত হয়। যুক্ত হওয়ার ফলে সে S2 সাবইউনিটের কাজ করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়। এরপর আমাদের শরীরের ফিউরিন প্রোটিন এসে S2 সাবইউনিটের S2′ প্রাইম জায়গায় যুক্ত হয় যেখান থেকে ফিউশন পেপটাইড বের হয়ে আসে। এই ফিউশন পেপটাইডের কারনে ভাইরাসের এবং মানব শরীরের কোষের পর্দা ভেদ করার জন্য অন্য প্রোটিনগুলো কার্জকর হয়ে যায়। এতো কথা বলার উদ্দেশ্য হলো ভাইরাসটির সুস্থ কোষের ভিতরে প্রবেশের পথে বাধা তৈরি করতে পারলে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবডি কিংবা ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার করার জন্য এই ধাপটি জানা অত্যন্ত জরুরি।

সাধারনত যেকোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আমাদের শ্বেতরক্তকনিকার লিম্ফোসাইট Memory B কোষে সেই জীবাণুর অ্যান্টিবডি তৈরির স্মৃতি রয়ে যায়। পরবর্তীতে সেই জীবাণু আবার শরীরে প্রবেশ করলে সে অ্যান্টিবডি তৈরি করে তাকে প্রতিহত করে। ভ্যাকসিন ব্যবহারের মূল বিষয় কিন্তু তাই। পূর্বে MERS-CoV কিংবা SARS-CoV ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে ঐসব মানুষের দেহ থেকে ঐ অ্যান্টিবডিগুলি বর্তমানের SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসটির S domain B (SB) এর সাথে যুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ ভ্যাকসিন তৈরি করা কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়।

SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসটির S domain B (SB) টি আকৃতি এবং মানবদেহের (ACE2) প্রোটিনটির সাথে আকর্ষণ ক্ষমতা কেমন? সেটি নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণা হয়নি। তবে পূর্বের SARS-CoV ভাইরাসের S domain B (SB) টি মানবদেহের (ACE2) প্রোটিনটির সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ১৪টি জায়গা রয়েছে। তবে নতুন SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসটির S domain B (SB) টিতে আগের থেকে ৮টি জায়গা ঠিক রয়েছে অর্থাৎ কনজারভেটিভ। বাকি ৬ জায়গায় পরিবর্তন হয়েছে। তবে এর ফলে আকর্ষণ ক্ষমতা কমে যায় নি। বরং আরও বেড়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে নতুন ভাইরাসের এই ডোমেইনের ৪৮৩ নম্বর জায়গায় একটি অতিরিক্ত ভ্যালিন অ্যামাইনো এসিড যুক্ত হয়েছে। ধারণা করছি এর ফলে এর ছড়িয়ে যাওয়ার হার বেড়ে গিয়েছে। SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসটির S1 domain B (SB) টি দেখতে ইংরেজি অক্ষর ‘V’ এর মতো। Cryo-Electron Microscopy মেশিন দিয়ে দেখা গেছে এই ডোমেইনটির অনেক প্রকারের ত্রিমাত্রিক আকৃতি সম্ভব। যেহেতু এখানে তিনটি মনোমার নিয়ে ট্রাইমেরিক আকৃতি হয়, S1 domain B (SB) টি তিনটি মনোমারেই অবস্থিত আছে। দেখা গেছে একটি খুলে গেলেও অন্য দুটি বন্ধ থাকে। আবার কখনো কখনো অন্য দুটি খোলা থাকে তো অপরটি বন্ধ থাকে। আবার অনেক সময় আংশিক খোলা থাকে। ফলে নানান রকমের আকৃতি দেখা যেতে পারে। তাই একে টার্গেট করে ওষুধ বের করা খুব মুশকিল। তবে আশার বাণী হচ্ছে SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসটির S2 সাবইউনিটটির সাথে পূর্বের SARS-CoV করোনা ভাইরাসের একই S2 ইউনিটের প্রায় ৯১% মিল রয়েছে। অর্থাৎ অ্যান্টিবডি বা ওষুধ তৈরি করতে পারলে দুটো ভাইরাসের ক্ষেত্রেই এটি কার্যকর হবে।

SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) টি যেহেতু গ্লাইকোপ্রোটিন তার মানে হলো এমন ধরনের প্রোটিন যেখানে প্রোটিনের সাথে গ্লাইক্যান অর্থাৎ শর্করা অণু যুক্ত থাকে। এই শর্করা অণুগুলি স্পাইক (S) প্রোটিনটির ফোল্ডিং, মানবদেহের প্রোটিয়েজ এবং অ্যান্টিবডিকে চেনাতে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে এরা অনেকটা আত্মরক্ষার জন্যও ব্যবহৃত হয়। কোন বহিঃস্থ অ্যান্টিবডি যাতে এদেরকে চিনতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। গবেষকরা দেখিয়েছেন এই সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করা সম্ভব। অর্থাৎ আমরা যদি কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কারও করি, তাহলে তা কিন্তু এই শর্করা অণুগুলিকেও চিনতে হবে।

আপনাদের জানার স্বার্থে বলছি শর্করা অণু প্রোটিনের সাথে তিনটি বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারে। অক্সিজেন, কার্বন এবং নাইট্রোজেন বন্ধন। এখানে এই গ্লাইকোপ্রোটিনের একটি মনোমারে ২২ টি জায়গায় শর্করা অণুগুলি নাইট্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে প্রোটিনের সাথে যুক্ত আছে। অর্থাৎ তিনটি মনোমারে মোট ৬৬ জায়গায় রয়েছে শর্করা অনুগুলি। অন্যদিকে SARS-CoV করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) টির একটি মনোমারে ২৩টি রয়েছে। অর্থাৎ মোট ৬৯টি শর্করা অণুসমষ্টি যুক্ত। SARS-CoV-2 করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) টির ২২টির মাঝে প্রায় ২০টি আগের SARS-CoV করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) টির সাথে মিল রয়েছে। তার মধ্যে S1 সাবইউনিটের ১৩ টির মাঝে ৯ টি এবং S2 সাবইউনিটের সবকটির মিল রয়েছে। অর্থাৎ ঝামেলা এই S1 সাবইউনিটে আছে, S2 সাবইউনিটে নেই। তাই আমাদের ভ্যাকসিনের ডিজাইনে S2 সাবইউনিটকে কাজে লাগাতে হবে, তাহলে একই ভ্যাকসিন দিয়ে আমরা অনেকগুলি ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবো। তবে সমস্যা হলো S2 সাবইউনিটের আগে S1 সাবইউনিট তার কাজ শুরু করে দেয়, অর্থাৎ ভাইরাসটির প্রথম যে অংশটি আংশিক উন্মুক্ত হয় তা হলো S1 সাবইউনিট। অন্যান্য করোনা ভাইরাস এতোটা মারাত্মক হয়নি কারণ তাদের এই ইউনিটটি সবসময় বন্ধ থাকে, যেমন সাধারন ঠাণ্ডাজনিত ভাইরাসগুলি। তাই এটিকে টার্গেট করে অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ আমাদের শরীরে যদি কোন অ্যান্টিবডি প্রস্তুত হয়, তা কিন্তু S1 সাবইউনিটকেই প্রথমে দেখতে পারবে বা চিনতে পারবে। এটাকে বলে ইমিউনিটি সিস্টেমের সিলেকশন প্রেশার।

তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইঁদুরকে SARS-CoV ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত করে তার শরীরে পলিক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়েছে। সেই অ্যান্টিবডি নতুন ভাইরাসটির সবচেয়ে মিল বেশি S2 সাবইউনিট এবং ফিউশন পেপটাইডের সাথেই যুক্ত হয়ে এই নতুন ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। যদিও অন্য অনেক অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়েছে S1 সাবইউনিটকে টার্গেট করে, যেগুলোও SARS-CoV ভাইরাসটির সাথে মানবদেহের সংযুক্ত হওয়াকে বাধা দিতে পারে। কিন্তু নতুন ভাইরাসটির ক্ষেত্রে সেই অ্যান্টিবডিগুলি কিরকম আচরণ করবে তা এখনো অস্পষ্ট।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

করোনা ভাইরাসের মলিকিউলার দৃষ্টিভঙ্গি : ২য় পর্ব

মতামত দিন
Loading...