ব্যাকটেরিয়া যখন আমাদের পরম বন্ধু

স্বপ্নীল আঁকাশ

0
মাদের চারদিকে রয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া(microorganisms). ধারনা করা হয়, পৃথিবীতে এই ক্ষুদ্র , আণুবীক্ষণিক অণুজীবের আবির্ভাব ঘটেছিলো মানুষ সৃষ্টির কোটি বছর আগে । কখনো কি ভেবেছেন অথবা আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে কখনো, কোথায় থাকে এরা? পৃথিবীর এমন কোনো স্থান পাওয়া যাবেনা যেখানে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক অনুজীব নেই।

হিমশীতল পর্বতের চূড়া থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীরতম বিন্দু ; সব যায়গায় এদের অস্তিত্ব বিরাজমান। এমনকি আমার আপনার শরীরের ভেতরেও রয়েছে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া।ঠিক যতগুলো দেহকোষ রয়েছে আমাদের দেহে, তার থেকেও বেশি রয়েছে অনুজীব। এখন হয়তো ভয় পাচ্ছেন, এগুলো আবার আমাদের দেহের ক্ষতি করছে না তো? ভয় পাওয়ার কোনো কারন নেই। আমাদের একটি প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে অনুজীব মানেই ক্ষতিকর। কিন্তু এই ধারনা সম্পুর্ন ভুল। ক্ষতিকর এবং উপকারী দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া ই রয়েছে।তবে আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে যেসকল ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয় নেয় এরা আমাদের শরীরে থেকে উপকারই করে।

এই ব্যাকটেরিয়াগুলো একদিকে যেমন আমাদের দেহে খাদ্য হজমে সাহায্য করে, অন্যদিকে ইমিউনিটি গড়ে তুলে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাও সক্রিয় করে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের শরীরে কিছু অপকারী অণুজীবের অনুপ্রবেশ ঘটে। এই সকল অণুজীবের কারনেই জ্বর থেকে শুরু করে প্লেগ, যক্ষা, কলেরা বা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের মতো ভয়ঙ্কর সব রোগের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেহের লড়াইটা তাদের বিরুদ্ধেই । আর সেজন্যেই কাটা দিয়ে কাটা তোলার মতই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থেকে তৈরি করা হয় একধরনের ওষুধ যাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক্স ।

এখন আসা যাক ব্যাকটেরিয়ার কিছু উপকারী দিক নিয়ে। একটি উদাহরণ নিয়ে আগানো যাক। E. coli এমন একটি ব্যাকটেরিয়া যা সাধারণত আমাদের অন্ত্রের ট্র্যাক্টে পাওয়া যায় এবং এই ব্যাকটেরিয়াটি সেখানে কোনো ক্ষতি ছাড়াই থাকতে পারে। তবে এটি যদি খাবারে থাকে এবং সেই খাবার আমরা খেয়ে ফেলি তবে সেটি আমাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এবং কি মৃত্যুও হতে পারে।

E. coli এর বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে যা এক ধরনের টক্সিন (বিষ) তৈরি করে। এই টক্সিন আমাদের দেহে কখনো কখনো মারাত্মক অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে এমন কিছু E. coli প্রজাতি রয়েছে যা মানুষের উপকার করতে পারে। এবং বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার ক্ষেত্রে প্রায়শই এদের ব্যবহার করে থাকেন।

এদের মধ্যে একটি প্রোবায়োটিক হিসাবে পরিচিত যাকে বলা হয় E. coli Nissle 1917। এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রোবায়োটিক কী?

দুটি গ্রিক শব্দ মিলে গঠিত হয়েছে প্রোবায়োটিক কথাটি। গ্রিক শব্দ ‘প্রো’ কথার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘প্রোমোটিং’। বাংলা অর্থ উন্নয়ন করা। আর ‘বায়োটিক’ কথার ইংরেজি অর্থ হল ‘লাইফ’, যার বাংলা প্রতিশব্দ জীবন। এবার এই দু’টিকে জুড়লে দাঁড়ায় জীবনের উন্নয়ন করা।

প্রোবায়োটিক কাজ করে কীভাবে?আসলে শরীরে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের কারণে ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার অনেক সময় খারাপ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের কারণেও ভালো ব্যাকটেরিয়া মারা যেতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য অনেক কারণেই শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে যেতে পারে বা তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে পারে। এরফলে স্বভাবতই শরীরে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থায় প্রোবায়োটিক শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। পাশাপাশি শরীরে ভালো এবং খারাপ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে স্বাভাবিক ভারসাম্যও ফেরায়।

এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে প্রোবায়োটিক কি তাহলে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে কাজ করে?

না, একদমই এরকম নয়। আমরা যখন অসুস্থ হই এবং শরীরে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেড়ে যায় তখন শরীরের এই খারাপ ব্যাকটেরিয়া নিধনের কাজে আমরাব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করে থাকি। এই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি ভালো ব্যাকটেরিয়াও মরে যায় আর শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানোর জন্য প্রোবায়োটিকের ব্যবহার করা হয়। এভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক এবং প্রোবায়োটিক পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় কয়েকটি রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সুফল পাওয়া না গেলে প্রোবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে আবারও বলছি, প্রোবায়োটিক কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প নয়।

সর্বশেষ এটাই বলবো আমাদের সকলের সচেতন হতে হবে, কেননা ব্যাকটেরিয়া নানাভাবে খাদ্যের সংস্পর্শে আসে, সেই খাবার খেলে পেটে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত মাংস পরীক্ষা করা এখনো কঠিন তবে অসম্ভব নয়। এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মাংস খাওয়ার আগে ভালো করে রান্না করে নেওয়া। তবে ই-কোলাই লেটুসের মতো কাচা সবজিতেও পাওয়া যায় এবং এটি সনাক্ত করা বা দূর করা তুলনামূলক কঠিন। সেক্ষেত্রে ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়াই উত্তম সমাধান।

লেখক: শিক্ষার্থী,ফার্মেসী বিভাগ , ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। 

মতামত দিন
Loading...