করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন থেকে আমরা কত দূরে ?

ড. এস এম আনিসুল ইসলাম

0

যদিও শুরু থেকে এই পর্যন্ত ১২০ টির বেশি ভ্যাকসিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সপ্লোর করা হয়েছে। এই সম্ভাব্য ভ্যাকসিন গুলোর মধ্যে মাত্র ১০ টি পটেনশিয়াল COVID-19 ভ্যাকসিন এই পর্যন্ত Clinical Trial এ যেতে সক্ষম হয়েছে। Clinical Trial কি সেই বিষয়ে একটু পর আসছি।

১) প্রথমেই বলা যাক, ভ্যাকসিন জিনিস টা আসলে কি?

ভ্যাকসিন হচ্ছে একটা বাহ্যিক উপকরণ (যেমনঃ দুর্বল অথবা মৃত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, অথবা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের এর শরীরের কিছু অংশ), যেটার সাথে আসল প্যাথজেন যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির সদৃশ্যতা রয়েছে, মানব শরীরে প্রবেশ করালে যেটা শরীরের সাধারন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে শরীরকে ঐ আসল প্যাথজেন সনাক্ত করে সেটাকে সহজভাবে ট্যাকল করতে সাহায্য করে। শরীর এই কাজটা করে কিছু ইমিউন কোষ যেমন Macrophage, T cell, B-Cell তৈরির মাধ্যমে। এই পুরো বিষয়টাকে বলা হয় ইমিউনিটি অথবা ইমিউন রেসপন্স। কিছু ভ্যাকসিন স্থায়ী হয় সারা জীবনের জন্য, আবার কিছু ভ্যাকসিন স্থায়ী হয় অল্প সময়ের জন্য।

২) একটা ভ্যাকসিন বাজারে আসতে কত সময় লাগতে পারে?

সাধারনত একটা ভ্যাকসিন ডেভেলপ করতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে, ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি সময়ও লাগতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে একটি ভ্যাকসিন আসতে এত সময় লাগার কারন কি? ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে একটা সময় সাপেক্ষ Multistage Research Process। এই সময় সাপেক্ষ Process এর উদ্যেশ্য হল এমন একটা ভ্যাকসিন তৈরি করা যা সত্যিকার অর্থে মানব দেহে কাজ করবে এবং যেটা খুবই সেইফ। এই Multistage Reseacrh Process গুলো হচ্ছেঃ

Exploratory Stage:
এটা হচ্ছে ভ্যাকসিন তৈরির প্রাথমিক পর্যায়, যেখানে গবেষকরা ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস রিলেটেড বিভিন্ন উপাধানগূলো (যেমন DNA, mRNA, Antigen) যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম তা বের করার চেষ্টা করেন। এই স্টেইজ মুলত সম্পাদন করা হয় বিভিন্ন কম্পিউটার সিমুলেশন মডেলে এবং পরীক্ষাগারে, কালচার পেট্রিডিসে ও ফ্লাস্কে।

Preclinical Stage:
কিছু ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটগুলো নির্বাচন করার পর সেগুলো এবার বিভিন্ন এনিমাল মডেলে ট্রাই করা হয়। এই স্টেইজ টা গবেষকদের বুঝতে সাহায্য করে সম্ভাব্য ভ্যাকসিনটি বায়োলজিক্যাল সিস্টেমে কাজ করতে সক্ষম কি না। অনেক ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট এই স্টেইজে বাতিল হয়ে যায় কেননা এগুলো কোনো ইমিউন রেসপন্স ঘটাতে পারেনা বলে।

Clinical Trial Stage:
একটা ভ্যাকসিন প্রিক্লিনিকাল ইভালুয়াশন এ পাশ করলে সংশ্লিষ্ট অথরিটি তখন FDA বরাবর (আমেরিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) একটা অ্যাপ্লিকেশান ফাইল করে যা Investigation New Drug অথবা IND নামে পরিচিত। FDA যদি IND অ্যাপ্লিকেশান অনুমোদন দেয় তখন ভ্যাকসিনটা মানুষের উপর পরীক্ষার জন্য অগ্রসর হয় যা নিম্নে উল্লেখিত বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্তঃ

Phase I Clinical Trial
Phase I এ ভ্যাকসিনটি ২০ থেকে ১০০ জন হেলথি ভলান্টিয়ার উপর পরীক্ষা করে দেখা হয়। এই Phase থেকে ফলাফল পেতে কয়েক মাস সময় লাগে।

Phase II Clinical Trial
এই পর্যায়ে ভ্যাকসিনটি কয়েকশ ভলান্টিয়ার এর উপর পরীক্ষা করে দেখা হয়। বলাবাহুল্য এই পর্যায়ে অনেক এক্সপেরিমেন্টাল সাব্জেক্টেরই ভ্যাকসিনের উপাধান যেমন পরীক্ষাকৃত ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুকি থাকে। এই Phase থেকে মুলত ভ্যাকসিন সেইফটি, ডোজ, ইমিউন রেসপন্স, মেথড অফ ডেলিভারী, ইত্যাদি দেখা হয়। এই Phase টা স্থায়ী হয় কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর।

Phase III Clinical Trial
Phase II থেকে সন্তোশজনক ফলাফল পাওয়ার পর, কয়েক হাজার মানুষের উপর ভ্যাকসিনটি পরীক্ষা করে দেখা হয় যাতে করে বড় এক্সপেরিমেন্টাল পপুলেশনে এর কার্যকারিতা কেমন তা দেখা যায়। এই Phase III ট্রায়াল সম্পন্ন হতে সাধারনত এক থেকে চার বছর পর্যন্ত সময় লাগে। Phase III সফল হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট অথরিটি তখন আবার FDA বরাবর (আমেরিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) আরেকটা নতুন অ্যাপ্লিকেশান ফাইল করে যা Biologics License Application অথবা BLA নামে পরিচিত।

Post Marketing Phase
FDA ভ্যাকসিনটির Clinical Trial ডাটা এবং মানুফ্যাকচারিং ফ্যাসিলিটি পর্যবেক্ষণ করার পর বাজারজাত করার ফাইনাল অনুমোদন দেয়। কিন্তু বাজারজাত করার পরও FDA ভ্যাকসিনের সেইফটি মনিটর করতে থাকে।
এই হচ্ছে একটা ভ্যাকসিনের শুরু থেকে বাজারে আসার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে এটা একটা লম্বা প্রক্রিয়া।

৩) করোনা ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট কোন পর্যায়ে?

শুরুতে যে ১০ টি পটেনশিয়াল COVID-19 ভ্যাকসিনের কথা বলছিলাম সেগুলোর মধ্যে ৩ টি আমেরিকায়, ৫ টি চায়নাইয়, ১ টি যুক্তরাজ্যে এবং ১ টি আমেরিকা, চায়না, এবং ইউরোপের যৌথ উদ্যোগ এ পরিচালিত হচ্ছে।

যে ভ্যাকসিনটি ডেভেলপমেন্টের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে সেটা হচ্ছে যুক্তরাজ্যে The University of Oxford, Astra Zeneca Biotech Company এবং Serum Institute of India এর যৌথ প্রচেস্টায় পরিচালিত AZD1222 ভ্যাকসিনটি যেটি এখন Phase III Clinical Trial এ রয়েছে। এই ভ্যাকসিনটির উপাধান হচ্ছে Non Replicating Viral Vector. আশা করা হচ্ছে আমরা এই ভ্যাকসিনটি এই বছরের শেষ নাগাদ পাবো যাদিও এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল ক্লিয়ার কোনো কিছু এখনও জানাইনি।

এছাড়া, আমেরিকার ১ টা (INO-4800, a DNA Based Vaccine by Inovio Pharmaceuticals) এবং চায়নার ১টা (Unnamed, The Institute of Medical Biology and Chinese Academy of Medical Sciences) ভ্যাকসিন ছাড়া অন্য সবগুলো Phase II Clinical Trial এ রয়েছে।

আমেরিকার যে ভ্যাকসিন নিয়ে সবাই সবচেয়ে বেশি আশাবাদী সেটা হচ্ছে The National Institute of Allergy and Infectious Diseases and Moderna Biotech ক্তৃক পরিচালিত mRNA নির্ভর mRNA-1273 ভ্যাকসিন যেটি এখন Phase II Clinical Trial এ আছে। Phase I Clinical Trial এ দেখা গেছে এই ভ্যাকসিনটি হেলথি ভলান্টিয়ার এর শরীরে COVID-19 এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে যা COVID-19 কে সফলভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম।

The National Institute of Allergy and Infectious Diseases (আমেরিকা) এর পরিচালক ডঃ এন্তনি ফাউসির মতে আমরা যদি Multistage Reseacrh Process টা অনেক কাট সাট করেও আগাই তাহলেও আমাদের এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে একটা সফল ভ্যাকসিন পেতে।

পরিশেষে, আমরা যদি খুব ভাগ্যবান হই এবং সবকিছু ক্লিক করে তাহলে হয়তোবা আমরা এই বছরের (২০২০) শেষে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের (২০২১) মাঝামাঝি জুন নাগাদ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পেতে পারি।

সবাইকে ধন্যবাদ।

মতামত দিন
Loading...