ফার্মাসিস্ট একটি মহৎ পেশা। যে পেশাতে সরাসরি সাধারণ মানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ আছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট যেসব পেশাজীবীদের উন্নত বিশ্বে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয় তার মধ্যে ফার্মাসিস্ট অন্যতম। ফার্মাসিস্টদের মূল কাজ হলো উন্নতমানের ওষুধ উৎপাদন, এদের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, সংরক্ষণ, ওষুধ বিক্রয় ও হাসপাতালে রোগীদের মাঝে বিতরণ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান, নিত্যনতুন ওষুধ উদ্ভাবন ইত্যাদি। অর্থাৎ ওষুধ সম্পর্কিত সকল বিষয়ে ফার্মাসিস্টরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে সমাদৃত। অথচ বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের অর্জিত জ্ঞানের কিয়দাংশ তাদের পেশাজীবনে ব্যবহার করতে পারছে। উন্নত বিশ্বের মতো হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা ওষুধের দোকানে তাদের অর্জিত জ্ঞানের ব্যবহারের কোন সুযোগই পাচ্ছে না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে জাতি ফার্মেসী বিষয়ে দক্ষ শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান এবং তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে ওষুধের নিরাপদ এবং যৌক্তিক ব্যবহার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাই এই প্রশ্নের অবতারণা। আমরা ফার্মাসিস্ট পেশাটিকে কেমন হিসেবে দেখতে চাই?
ওষুধের ব্যবহার কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাস থেকে জানা যায়, আগেকার দিনে যিনি রোগ নির্ণয় করতেন অর্থাৎ চিকিৎসক তিনিই বিভিন্ন ধরণের ওষুধ তৈরি করে রোগীকে প্রদান করতেন। অর্থাৎ রোগ নির্ণয় এবং ওষুধ প্রদান দুটোই একজন করতেন। অথচ জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে এই দুটি ক্ষেত্রে ব্যাপক জ্ঞান সন্নিবেশিত হয়। ফলে একজনের পক্ষে রোগ নির্ণয় এবং ওষুধ প্রস্তুতকরণ জ্ঞান আহরণ এবং আত্মস্থ করা দুরূহসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে কাজ দুটি সুচারুভাবে নিরূপণের উদ্দেশ্যে চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্ট পেশার উদ্ভব হয়েছে বিংশ শতাব্দীতে এসে। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশে ফার্মাসিস্টরা হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা ওষুধের দোকানে অবশ্যম্ভাবী একজন।
উন্নত বিশ্বের হাসপাতালে একজন রোগীর আগমনের সাথে সাথে যেসব কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয় তার একটি বাস্তব চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। একজন মানুষ অসুস্থ হলে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। প্রাথমিকভাবে একজন চিকিৎসক বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক উপায়ে আপনার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করবেন। সেক্ষেত্রে যে সমস্ত মেশিনের ব্যবহার করতে হয়, সে মেশিনের উপর দক্ষ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট রয়েছে। এরপর রোগ নির্ণয় হয়ে গেলে তিনি ব্যবস্থাপত্র প্রদান করবেন। ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) অনুযায়ী নার্স সেই রোগীদের সেবা প্রদান করবেন। অপরদিকে সেই ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) অনুযায়ী একজন ফার্মাসিস্ট ওষুধ সরবরাহ করবেন। ওষুধ সরবরাহ করার সময় তিনি রোগীর বয়স, রোগের মাত্রা, পূর্বে ব্যবহৃত ওষুধ, কিংবা বর্তমানে ব্যবহৃত ওষুধের তালিকা, প্রদত্ত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, শারীরিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা করে ওষুধের ডোজ নির্ধারণ করে থাকেন। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসকের প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্র নিয়ে কোন ধরনের অসঙ্গতি পেলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ওষুধ পরিবর্তনও করতে পারবেন। যে সমস্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় না, তাদের ওষুধ বিতরণ করার সময় বিভিন্ন ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি হাসপাতালে কোন ধরনের ওষুধ রাখতে হবে, তাদের সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন একজন দক্ষ ফার্মাসিস্ট। শুধু তাই নয়, কমিউনিটি মেডিসিন বিষয়ক সাধারণ জনগণকে জনস্বাস্থ্য, ওষুধ, সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ নানান বিষয়ে সচেতন করতে সহায়তা করেন। অর্থাৎ প্রতিটি হাসপাতালের ফার্মেসী ও থেরাপিউটিক কমিটির একজন অন্যতম প্রধান সদস্য হলেন ফার্মাসিস্ট। তাদের সার্বিক সহায়তা এবং উপস্থিতি ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা করা অকল্পনীয়।
উন্নত বিশ্বের প্রতিটি শহরে, গ্রামে, পাড়ায় অন্তত একটি করে মডেল মেডিসিন দোকান রয়েছে। আপনি চাইলেই যত্রতত্র ওষুধের দোকান দেয়ার অনুমতি সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে পাবেন না। সাধারণত জনগণের ঘনত্ব বিবেচনা করে এলাকাভিত্তিক ওষুধের দোকানের অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে। ওষুধের দোকানে একজন দক্ষ ফার্মাসিস্ট ব্যতীত ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় আইনত নিষিদ্ধ। তবে ওভার দ্যা কাউন্টার ড্রাগ নামে অত্যাবশ্যকীয় কিছু ওষুধ সেই দোকান থেকেই বিনা অনুমতি নিয়ে কিনতে পারবেন। সেখানেও একজন ফার্মাসিস্ট ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নিবেদিত হন। ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত যেহেতু ওষুধ দেয়া হয় না, ফলে ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার সুনিশ্চিত হয়। বিশেষ করে ঘুমের ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ, বিষ জাতীয় ওষুধ কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ। এছাড়া ওষুধ সম্পর্কিত সাময়িক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়ার সহজ সমাধান দেয়া হয়। ওষুধ প্রস্তুতের নিয়মাবলী, ওষুধ গ্রহণের সময় কিংবা ওষুধ সম্পর্কিত নানান তথ্য রোগীদের কিংবা রোগীর আত্মীয়স্বজনদের দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়াতে কোন পাড়ায় অবস্থিত ওষুধের দোকানে কর্মরত একজন ফার্মাসিস্ট উক্ত পাড়ায় আক্রান্ত যেকোনো রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ব্রিটেনে ফার্মাসিস্টদের নির্দিষ্ট কিছু রোগীর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ দিয়ে ব্যবস্থাপত্র প্রদানেরও অধিকার দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রোগীদের ডাটাবেইজ নিয়মিত হালনাগাদ করার কাজটি করা হয়ে এখানে। অর্থাৎ একজন রোগীর প্রগ্নোসিস সম্পর্কে তথ্য রয়ে যায়। যার ফলে একটি শহরের রোগের প্রকোপ সম্পর্কে তথ্য জোগান দেয়া সম্ভব হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্য নিয়ে জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেখানে একটি কমিউনিটি রোল মডেল স্থাপন করা হয়।
ফার্মেসী একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়। এখানে একজন শিক্ষার্থীকে একদিকে ওষুধের উৎপাদন, গুণগত মান নিশ্চিতকরণ সম্পর্কে যেমন জানতে হয়, তেমনি ওষুধের নিরাপদ ব্যবহারের উপর দক্ষতাও অর্জন করতে হয়। টেকনোলজির এই যুগে এসে একজনের পক্ষে এতো বিষয় জানা সম্ভব হয়না বিধায় সাম্প্রতিককালে উন্নত বিশ্বে দুই ধরণের ডিগ্রী ফার্মেসীর শিক্ষার্থীদের প্রদান করা হয়। যারা হাসপাতাল কিংবা কমিউনিটিতে কাজ করবেন তাদের জন্য ফার্ম ডি ডিগ্রী প্রদান করা হয়। এই ডিগ্রীটি পেতে একজন শিক্ষার্থীকে ছয় বছর ধরে পড়াশুনা করতে হয়। খেয়াল করে দেখুন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকও কিন্তু ছয় বছর ধরে পড়াশুনা করেন। অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল সাইটে দক্ষতা অর্জনের জন্য একজন ফার্মাসিস্টকেও পাঁচ বছর মেয়াদী বিষয়ভিত্তিক পড়াশুনা এবং এক বছর হাসপাতালে ইন্টার্নশীপ অর্থাৎ মোট ছয় বছর সময় ব্যয় করতে হয়। ফার্ম ডি ডিগ্রীর কারিকুলাম পুরোপুরি রোগীকেন্দ্রিক। এখানে একজন শিক্ষার্থী ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ইমিউনলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসী, হসপিটাল ও কমিউনিটি ফার্মেসী, ফার্মাকোথেরাপি, ডিজিজ ম্যানেজমেন্ট, বেসিক কম্পাউন্ডিং, অ্যাডভান্স বায়োফার্মাসিউটিক্স, টক্সিকোলজি, ফার্মাকোভিজিল্যান্স ইত্যাদি ধরণের বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করে। ফলে একজন রোগীর ওষুধ দেয়ার সময় যেসব জ্ঞান দরকার, সেসব এই কোর্সসমূহে পড়ানো হয়। ফলে চিকিৎসকের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা রোগীর যথোপযুক্ত চিকিৎসা এবং সেবা নিশ্চিত করে। তারা চিকিৎসকের মতো সমমর্যাদা এবং সমবেতন পেয়ে থাকেন। ফলে উন্নত বিশ্বে ফার্ম ডি ডিগ্রীধারী ফার্মাসিস্ট ছাড়া হাসপাতাল কিংবা কমিউনিটি ওষুধের দোকান অকল্পনীয়।
অপরদিকে ওষুধ কিংবা চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা এবং ওষুধ উৎপাদন, বিতরণ, সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজের অর্জনের জন্য ফার্মেসী বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে চার বছর মেয়াদী বি ফার্ম সম্মান ডিগ্রি প্রদান করা হয়। যেখানে মূলত ওষুধের উৎপাদন সংক্রান্ত অর্থাৎ ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি, ফার্মাসিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যানালাইসিস, কোয়ালিটি কন্ট্রোল এবং অ্যাসিউরেন্স, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি, ফার্মাকোগনসি ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয়। আজ বাংলাদেশের পঞ্চাশটিরও বেশি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী বি ফার্ম সম্মান বিষয়টি পড়ানো হয়, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৪ সালে। অর্ধশতাব্দী পুরনো এই বিষয়ের আবির্ভাবের ফলেই আজ বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশেও ওষুধ রপ্তানি করছে। আজ ওষুধ কোম্পানি গুলোতে হাজার হাজার ফার্মাসিস্ট কাজ করছে। তারা বি ফার্ম পাশ করে তাদের অর্জিত জ্ঞানের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে জাতিকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বি ফার্ম সম্মান পাশধারী শিক্ষার্থীরা কোম্পানিতে তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে সন্দেহাতীত ভাবে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো উন্নত বিশ্বের মতো ক্লিনিক্যাল সাইটে ফার্মাসিস্টের কদর এই দেশ দিতে এখনো অসমর্থ। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারত, থাইল্যান্ড, নেপাল, শ্রীলঙ্কা কিংবা একাত্তরে পরাজিত শক্তি পাকিস্তানেরও সরকার ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব বুঝে তাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফার্ম ডি কোর্স চালু করেছে সম্প্রতি। তারাও ক্লিনিক্যাল সাইটে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিচ্ছে ফলে ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে একজন রোগীর ওষুধ সম্পর্কিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। ঠিক এই ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আমরা উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর কথা দূরে থাক, পার্শ্ববর্তী দেশের সাথেও একই তালে এগিয়ে যেতে পারছি না। তবে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগের জন্য কাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। দেরীতে হলেও সব হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগের কোন বিকল্প নেই। সব ওষুধের দোকানে এই মুহূর্তে এ গ্রেড ফার্মাসিস্ট দেয়া সম্ভব না হলেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকার আর কোন সুযোগ নেই।
স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই। তাই স্বপ্ন দেখি বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে যখন কোন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি, তখন একজন ফার্মাসিস্ট আমাকে ওষুধ সেবা দিচ্ছেন, সাথে ওষুধ বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। আরো দেখি ওষুধ কিনতে কোন এক ওষুধের দোকানে গিয়েছি, সেখানেও একজন ফার্মাসিস্ট আমাকে ওষুধ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। স্বপ্নগুলো সত্যি হবে কি?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।