ছোট্ট একটি জীবাণু করোনা ভাইরাস, যে কিনা আমাদের সব দিন এক করে দিয়েছে।যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বুঝা যায় না, সেই ক্ষুদ্র জীবাণু আজ সারা জগতে মানুষের জীবনযাত্রায় আমুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
এখন আর উৎসবের দিন,ছুটির দিন কিংবা বিশেষ দিন বলে কিছু নেই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে।প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রাক্কালে মাস্ক, গ্লোভস সহ অনন্য পিপিই ঠিকমত পড়েছি কি না সেটাই খেয়াল রাখাই এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।সাথে তো ২.৩০ মিনিটের স্বাস্থ্য বুলেটিন রয়েছেই। করোনা ভাইরাস নিয়ে নতুন করে আর বলার কিছু নেই। সরকারী ভাবে সকল নির্দেশনা, প্রেসব্রিফিং এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে করোনা ভাইরাসের লক্ষন,প্রতিকার-প্রতিরোধ পদ্ধতি,আপদকালীন যোগাযোগের ঠিকানা ইত্যাদি আমরা মোটামুটি ভাবে ভালই জেনে গেছি।এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি।
প্রথমেই আসি আমাদের অতিপরিচিত একটিশব্দ ‘লকডাউন’ প্রসঙ্গে। লকডাউন দরকার আছে কি না না কি নেই সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছিনা।কারন এই প্রসঙ্গে টিভি-টকশো থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লার চায়ের দোকান পর্যন্ত আলোচনা চলছে-চলবেই।যেকোন সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।অস্বাভাবিক সেটাই যেটা আমরা আলোচনা-সমালোচনা করি অথচ নিজে তা মানি না বা মানতে চাই না।কিংবা মেনে নেওয়ার মত সহজাতপ্রবৃত্তি আমাদের মাঝে অনেকেরই কম রয়েছে। সামগ্রিকভাবে লকডাউন হয়তো দেখে শুনে বুঝেই রাষ্ট্রনির্ধারণ করে থাকে কিন্তু আমাদের নিজ ঘরে লকডাউন থাকবে কি থাকবেনা সেটাতো আর সংশ্লিষ্ট মহল ঠিক করবে না।আপনার ঘরে আপনিই সরকার,আপনিই বিরোধীদল।আপনার নিয়মেই চলবে লক ডাউনের লক এবং আনলক।
আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার পার হওয়ার পরেও আমরা অনেকেই মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছি, প্রায় দিনই বাজার ঘাট সহ জনসমাগম স্থলে ভিড় করছি, চায়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছি ইত্যাদি।আবার সেই আমরাই ঘরে ফিরে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলছি। সামাজিক দূরত্বের তো বালাই ই নেই। এই দায় কার? সারা বছব্যাপী নিয়ম আর আইন করে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভ্যাসগুলির পরিবর্তন খুব একটা সহজ বিষয় নয়। সচেতনতা আসে মুল্যবোধ থেকে যা কিনা বিবেক তাড়িত হয়ে ভাল-মন্দের তুলনা শেখায়।আমরা নিজেরা সচেতন না হলে কখনোই এই জীবাণুর হাত থেকে রেহাই পাবো না।
এবার আসি মাস্কের কথায়।কোন ধরনের মাস্ক পড়ব এই নিয়ে আমরা নিতান্তই চিন্তায় পরে যাই।N95, FFP2,সার্জিকাল না কি কাপড়ের মাস্ক।বাজার করতে গেছেন,দেখলেন যে বিক্রেতা কোন মাস্ক ই পরেন!,তাহলে কি হবে আমাদের? এই মাস্কের তুলনামুলক আলোচনা বা সমালোচনা করে।কারন তার মাধ্যমেই তো আমরা সংক্রমিত হতে পারি।এমতাবস্থায় আপনার পাশের মানুষটিকেও যেভাবে হোক মাস্ক পড়াতে হবে।যেহেতু করোনা সংক্রামক ব্যাধি, সবাই কে সচেতন না করতে পারলে কোন কাজ হবে না।
একদিনের ঘটনা শেয়ার করি, বাজারে গেছি সীমিত আকারে জরুরি কিছু কিনবো বলে।গিয়ে দেখি দোকানদারের মাস্ক আছে কিন্ত মুখে নাই,একপাশে রাখা জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মাস্ক পড়েন নাই কেন? উত্তরে আসলোঃ কিছু হব না স্যার, আমাগো এই এলাকায় সব ভালো মানুষ থাকে।আমি বললাম, করোনা ভাইরাসতো আর ভাল মন্দ কিছু বুঝেনা,সচেতন না হলে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।জোর করে হইলেও আমি সেদিন মাস্কটা পড়িয়ে এসেছি।এরপরের বার পড়বে কিনা সে খেয়াল কে রাখবে!আইন করে হয়তো বাইরের বিষয়গুলো ঠিক করা যাতে পারে, বিবেকের বিষয়গুলো কিভাবে আইন দ্বারা সামলাবেন?সে আইনতো পরিবার আর শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ দ্বারা বেষ্টিত। কাজেই, আত্নসচেতনতাই আমাদের পারবে এই মহামারী থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে।
এখন করোনা মহামারী চলছে।পূর্বে ও কলেরা,প্লেগ এর মত মহামারী রোগ ছিল, সামনে হয়তো আরোও নতুন কিছু আসবে।তাই মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে এখনই আরোও ব্যাপকহারে জানতে-বুঝতে হবে।দরকার আরোও প্রচার আর প্রসারনা।জানতে হবে জীবাণূকি,এদের বিস্তার প্রতিকার-প্রতিরোধ সম্পর্কে।পাঠ্যপুস্তকে প্রতিটি শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে জীবাণূ বিষয়ক সাধারনজ্ঞান গুলো।বেসিক মাইক্রোবায়োলজি সম্পর্কে জানতেই হবে।এমন একটা অবস্থায় আমাদেরকে নিয়ে যেতে হবে যেখানে বিক্রেতা নিজ থেকেই মাস্ক পড়বে, জোর করতে হবেনা, সবাই নিজ থেকেই লকডাউন মানবে। এমতাবস্থায় মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে ধারনা যদি স্কুলে থেকেই দেওয়া যায়, তাহলে অনেকাংশেই সচেতনতা বাড়বে বলে আশা করা যায়।
অধিকন্তু মাইক্রোবায়োলজি-বায়োকেমিস্ট্রি সাবজেক্ট এর মত টেকনিক্যাল জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষজনশক্তি খুবই প্রয়োজন। সঠিকভাবে স্যাম্পল কালেকশন, সংরক্ষন এবং রোগনির্ণয়ে টেকনিক্যালজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই।হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগও এখন সময়ের অন্যতম দাবী।সবি হচ্ছে তবে তাপ্রয়োজনেরতুলনায় খুবই অপ্রতুল।
পরিশেষে, সকল করোনা যোদ্ধাদের (ডাক্তার, নার্স,প্রশাসনসাংবাদিক, ব্যাংকার,ফার্মাসিস্ট-মাইক্রোবায়োলিজষ্ট-কেমিষ্টসহউৎপাদন বিপননেজড়িতসকলেই)সাথে আমাদের সাধারন জন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব জীবানুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে।ঈশ্বর আমাদের সহায় হন।
লেখক: মাইক্রোবায়োলোজিষ্ট , দেশীয় ঔষধ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ।