ভ্যাক্সিনের ইতিবৃত্ত ও করোনা প্রসঙ্গ

করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে একস্থবিরতা। বিশ্ব এখন তাকিয়ে ভ্যাক্সিনের দিকে।কখন ভ্যাক্সিন আসবে আর কখন আবার এই পৃথিবী ফিরে যাবে তার চিরচেনা রুপে, সেই অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হচ্ছে না।তাই আজ আলোচনার বিষয়বস্তু ভ্যাক্সিন ।ভ্যাক্সিন কি এবং কিভাবে এটি তৈরি করা হয় একটি নিদির্ষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করার জন্যে ।

১৭৯৮সালে বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার প্রথম ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেন ।  তিনি দেখতে পান যে গোয়ালিনীরা যারা মৃদু কাউ পক্স রোগের সংস্পর্শে ছিল তারা পরবর্তীতে তীব্র রোগস্মল পক্সের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে অর্থাৎ তাদের আর স্মলপক্স রোগটা হচ্ছেনা। এই ধারনাকে প্রমাণ করার জন্যে জেনার কাউপক্সের ফুসকুড়ি থেকে তরল পদার্থ নিয়ে একজন আটবছরের ছেলের রক্তে টিকা আকারে দিয়ে দেন।পরবর্তীতে তিনি দেখতে পান ঐ ছেলের আর স্মলপক্স রোগ হচ্ছে না।পরর্বতীতে বিজ্ঞানী পাস্তুর ও জেনারের মতবাদের প্রমান পেয়ে তিনি তার নামকরণ করেন ভ্যাক্সিন।

বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাক্সিন  যেমন জীবিত কিন্তু ক্ষয়প্রাপ্ত জীবাণুর  ভ্যাক্সিন, মৃতবানিস্ক্রিয়  জীবাণুরভ্যাক্সিন, ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া রক্ষুদ্র অংশের ভ্যাক্সিন, নিদিষ্ট জীবাণুর আমিষ অথবা শর্করা অংশের ভ্যাক্সিন, ডিএনএ ভ্যাক্সিন, আর এন এভ্যাক্সিন, রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ ভ্যাক্সিন ইত্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে।

কোন নিদির্ষ্ট নিস্ক্রিয় জীবাণু বা জীবাণুর দেহের কোন নিদির্ষ্ট অংশ কতৃক তৈরিকৃত ভ্যাক্সিন যখন মানবদেহে টিকা আকারে দেয়া হয়।তখন মানবদেহ এটিকে নিজের নয় এমন বস্তু মনে করে এবং এটির বিরুদ্ধে  এন্টিবডি তৈরি করে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলে। ভ্যাক্সিনের নিদির্ষ্ট জীবাণু টি মানবদেহে কোন রোগ তৈরি করতে পারেনা কারন ভ্যাক্সিন তৈরি করার সময় জীবাণুটির রোগ তৈরি করার ক্ষমতা কে নষ্ট করে দেয়া হয়।বহিরাগত বস্তুটিকে দেহে তৈরিকৃত এন্টিবডি দ্বারা ঘিরে ধরে ফেলে এবং পরিশেষ এটিকে মেরে ফেলে।এই নিদির্ষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে তৈরিকৃত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঐ মানবদেহের স্মৃতিতে সারাজীবনের জন্যে থেকে যায়।  যদি কখনও ঐ মানবদেহে প্রকৃতি থেকে ঐ নিদির্ষ্ট জীবানুটির আবার অনুপ্রবেশ ঘটে তবে ঐ মানবদেহ আবার এটিকে নিজের নয় এমন বস্তু মনে করে এবং তার স্মৃতি কোষ থেকে আবার এন্টিবডি তৈরি করা শুরু করে এবং জীবাণুটি কে মেরে ফেলে৷এইভাবে ঐ মানবদেহটি সারাজীবনের জন্যেঐ নিদির্ষ্ট জীবাণুটির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে।

আর একটি জীবাণুর বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার খুবই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।ইবোলা ভাইরাস আবিষ্কার হয়েছিল আজ থেকে ৪৩বছর আগে কিন্তুই বোলার ভ্যাক্সিন অনুমোদন  পায় গত বছর।জীবাণুর ক্রমাগত বিবর্তন  ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের একটি উল্লেখ্যযোগ্য প্রতিবন্ধকতা।  গড়ে ১০ বছরের মত সময় লেগে যায় একটি জীবানুর বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে।তবে ধারনা করা হয় কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এর ব্যাতিক্রম ঘটবে।করোনার ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন আশা করা যাচ্ছে কারণ মানবদেহে করোনার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে যা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত সত্য। তাই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন কোন ভ্যাক্সিন ডিজাইন করতে যা অনুরূপ এন্টিবডি তৈরি করতে পারে।

একটি ভ্যাক্সিন তৈরি করার পর ঐ ভ্যাক্সিনটিকে অনেক গুলো ধাপে এর পরিক্ষা করা হয়। প্রথমে
ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা পরিক্ষা করা হয় জীবজন্তু যেমন ইঁদুর,  বানর ইত্যাদির উপর এবং দেখা হয় ঐ প্রাণীর রক্তে আসলেই ঐ জীবাণুর বিরুদ্ধে  এন্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা। আর এটা কেবলে প্রি-ক্লিনিক্যালট্রায়াল।  এরপর শুরু হয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল,  যার ধাপ৩টি। প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে উত্তীর্ন হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে এর কার্যকারিতা দেখা হয় অল্প কিছু মানুষের উপর (প্রথমধাপ), ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ১ম ধাপের উদ্দেশ্য এইটা মানবদেহ প্রয়োগের উপযোগী কিনা তা যাচাই করা। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে কোন প্রকার প্বার্শপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয় কিনা তা নির্ধারণ করা।তারপর কার্যকারিতা দেখা হয় কমপক্ষে এক হাজার মানুষের উপর প্রয়োগ করে (দ্বিতীয়ধাপ), পরিশেষে সহস্রাধিক মানুষের উপর ভ্যাক্সিনটি প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা পরিক্ষা করা হয় (তৃতীয়ধাপ)।প্রতিটা ধাপে ভ্যাক্সিন যদি কোন লক্ষ্যনীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া কার্যকারি হয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ভ্যাক্সিনটিকে অনুমোদন দেয়।

বর্তমানে ১৪০টির ও বেশী  করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন  বিভিন্নধাপে পরিক্ষা নিরিক্ষার কাজ চলছে । বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করোনা ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করে অথবা করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন অংশ যেমন স্পাইক প্রোটিন,  এম আর  এন এ কে লক্ষ্য করে ভ্যাক্সিন আবিস্কার করার দিন রাত চেষ্টা করে যাচ্ছে।আর মহামারী বিবেচনায় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা গুলো  প্রি-ক্লিনিক্যাল এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পূর্বনির্ধারিত সময়ে ছাড় দিচ্ছে।তাই ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা পাওয়া গেলে দ্রুতই তা অনুমোদন পাবে ।আর এই চেষ্টা একদিন সফল হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবী ফিরে পাবে তার চিরচেনা রুপ।

লেখক: সিনিয়র মাইক্রোবায়োলজিস্ট,এসিআই হেলথকেয়ার লিমিটেড। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *