যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম তখন সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের মধ্যে পড়েছিলাম রক্ত এক ধরনের তরল যোজক কলা। তখন ছোট ছিলাম।। বুঝতাম না এটি আবার কোন প্রকার কলা! তাই মজা করে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলতাম আমাদের শরীর অসংখ্য কলার সমন্ময়ে গঠিত কিন্তু এখন বুঝি এই কলার গুরুত্ব কতটুকু! মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই রক্ত। শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ নষ্ট হলেও মানুষ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু রক্তের অভাবে বা রক্তে কোনো সমস্যা হলে মানুষ সরাসরি কুপোকাত।
বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় জরুরি মুহূর্তে অনেকেরই রক্তের প্রয়োজন হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা থাকলেও নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত না পাওয়ার ফলে মারা যান অনেক মানুষ।
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যত ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে সকল ধর্মেই মুমূর্ষুকে দানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই দান যদি হয় রক্ত, তবে তার মহত্ব ছাড়িয়ে যায় অন্য সব কিছুকে।কারণ একজনের দান করা রক্ত বাঁচাতে পারে অন্যের জীবন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার বাণীতে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ তার অপর ভাইয়ের উপকার করতে সক্ষম হলে সে যেন তা করে (মুসলিম)।’
রক্ত দান বা ইংরেজিতে Blood donation বলতে কি বুঝি?
কোন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেবার প্রক্রিয়াকে রক্ত দান বলে। একজন মানুষের বিভিন্ন কারনে রক্তের প্রয়োজন হতে পারে।যেমন নানা অসুখ-বিসুখ কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে অনেকেরই রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্ত নিয়ে কাজ করে এরকম অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে যারা মানুষের কাছ থেকে বিশুদ্ধ রক্ত সংগ্রহ করে যাদের প্রয়োজন তাদের দান করে। আমরা জানি যে মানবদেহে লোহিত রক্তকণিকা সাধারণত ৩ থেকে ৪ মাস থাকে। আমাদের অনেকের একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে রক্তদান করলেই শরীরে রক্তের ঘাটতি দেখা দেবে এমন ভাবা কখনো ঠিক নয়। গবেষণায় দেখা গেছে রক্তদান করলে বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা পাওয়া যায়।
২০১৩ সালে আমেরিকান জার্নাল অব এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়মিত রক্তদাতাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৩৩ ভাগ কম এবং তাদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি কম ৮৮ ভাগ। রক্তদান করলে দাতার শরীরে লৌহের পরিমাণ কমে যাওয়াকেই এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন বিজ্ঞানীরা।
রক্ত দান কিভাবে আমাদের সুস্থ রাখে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে?
রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার ফলে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ যেগুলো নতুন কণিকা উৎপন্ন করে। এই ”বোন ম্যারোগুলো” রক্ত দান করার সাথে সাথে নতুন রক্ত তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং রক্তদানের ২ সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকার জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের মতে একজন সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক লোক বছরে ৩ বার রক্তদান করতে পারেন। একজন মানুষ রক্ত দান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
তাছাড়াও রক্ত দানে অনেকগুলো উপকারীতা রয়েছে সেগুলো নিচে তোলে ধরা হলো
রক্তদান শরীরের ওজন কমায়:
আমাদের অনেকেই শরীরের ওজন কমানোর জন্য ডায়েট করে থাকি এমন কি উপবাস থেকেও চেষ্টা করে থাকি শরীরের ওজন কমানোর জন্য। কিন্তু আপনি যেনে খুশি হবেন যে প্রতি একবার রক্ত দিলে ৬৫০ ক্যালরি করে শক্তি খরচ হয়। তখন দেহ তা পূরণের জন্যে কাজে নিয়োজিত হয় । যার ফলে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
হিমোক্রোমাটোসিস প্রতিরোধ করে:
রক্ত দানের মাধ্যমে, আপনি হিমোক্রোমাটোসিসের ঝুঁকি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন। দেহে অতিরিক্ত লৌহের উপস্থিতিতে এই রোগ হয়। এই রোগে লৌহ বা আয়রন বিভিন্ন অঙ্গে জমা হতে থাকে, এমনকি হার্টেও। নিয়মিত রক্তদানের ফলে শরীরে আয়রনের অতিরিক্ত মাত্রা হ্রাস হয়, যা হিমোক্রোমাটোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য উপকারি হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক এবং লিভারের বিভিন্ন অসুখের ঝুঁকি হ্রাস করে:
আয়রন ওভারলোডকে হৃৎপিণ্ড, লিভার, অন্ত:স্রাব গ্রন্থি এবং সারা শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন অঙ্গে অতিরিক্ত আয়রন জমে থাকার বিষয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ২০১৩ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেশি হলে হৃদরোগ এবং লিভারের অসুস্থতার ঝুঁকি বেশি থাকে। নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে আপনি নিজের শরীরের অতিরিক্ত আয়রন প্রতিরোধ করতে পারেন। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে আপনার হৃদরোগ এবং লিভারের অসুস্থতার ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়:
বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো ক্যান্সার। রক্তদান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করতে পারে। যদি আপনি আপনার শরীরের আয়রনের স্তরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে লিভার ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার এবং অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমতে পারে।
নতুন রক্তকণিকা তৈরি:
রক্তদানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আপনার শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হবে। নতুন রক্তকণিকা আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে।
অকালবার্ধক্যের ঝুঁকি কমায়: রক্তদানের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করা আপনাকে স্বর্গীয় মানসিক শান্তি এবং তৃপ্তি প্রদান করবে। এটি আপনাকে মানসিক চাপ মুক্ত করতে সহায়তা করবে, যা অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া রক্ত দেয়ার পর শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয় যা অকালে ত্বক কুঁচকে যাওয়া কমায়।
কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়:
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রক্তদান করলে কোলেস্টেরল, লিপিড এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হ্রাস পায়। এছাড়া রক্তকণিকাগুলো আয়রন দিয়ে তৈরি হয়, যা অতিরিক্ত হলে রক্তনালীগুলোর কাজ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিয়মিত রক্তদান করার মাধ্যমে আপনি অতিরিক্ত আয়রন প্রতিরোধ করতে এবং কোলেস্টেরল বজায় রাখতে পারেন।
রক্তদানের কি কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে?
অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে যে রক্তদানে প্রতিক্রিয়া রয়েছে।সুস্বাস্থের অধিকারী প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য রক্তদানের ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি নেই। প্রত্যেক রক্তদাতার জন্য নতুন/জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। সুতরাং রক্তদানের ক্ষেত্রে দাতার কোনো ঝুঁকি নেই।
প্রাপ্ত বয়স্ক সবাই কি রক্ত দান করতে পারবেন?
না! সবাই রক্ত দান করতে পারবেন না।রক্ত দানের ক্ষেত্রে রক্তের দাতা ও গ্রহীতার সম্যক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি।
কাদের রক্ত দেয়া উচিত নয় ?
● যাদের শ্বাস–প্রশ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি বা অ্যাজমা রয়েছে।
● রক্তবাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন, হেপাটাইটিস বি বা সি, জন্ডিস, এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি থাকলে রক্ত দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া টাইফয়েড, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, বাতজ্বর, হৃদ্রোগ থাকলেও রক্ত দেওয়া উচিত নয়।
● নারীদের মধ্যে যাঁরা অন্তঃসত্ত্বা ও যাঁদের ঋতুস্রাব চলছে তাঁরা রক্ত দেবেন না, সন্তান জন্মদানের এক বছরের মধ্যেও না।
● যাঁরা কিছু ওষুধ সেবন করছেন, যেমন, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি তাঁরা সে সময় রক্ত দেবেন না।
● হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যাদের তুলনামুলক কম (পুরুষদের ন্যূনতম ১২ গ্রাম/ডেসিলিটার এবং নারীদের ন্যূনতম ১১ গ্রাম/ডেসিলিটার হতে হবে) থাকলে।
● রক্তচাপ(বি পি) ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক না থাকলে রক্ত দেওয়া ওই মুহূর্তে রক্ত দেয়া উচিত নয়।
● যাঁদের বিগত ৬ মাসের মধ্যে বড় কোনো দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁরা রক্ত দেবেন না।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ , ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ।