পৃথিবীর বুকে “বাংলাদেশ” নামটি যখন উচ্চরিত হয়, অনেক বেশি গৌরবান্বিত বোধ করি। একাত্তরে বাংলাদেশ জন্মের পর অনেক দেশ জন্ম নিয়েছে, বিশ্ব র্যাংকিংএ বাংলাদেশকে পিছিয়ে অনেক দেশ অনেক দিক থেকে এগিয়ে গিয়েছে। তারপরও সকল ঘাটতি ও ত্রুটিকে পাশ কাটিয়ে আমাদের যা আছে তাই নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আশা আর ভরসা নিয়ে। এরই মাঝে বিশ্ব মানচিত্রে প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের ছোট মানচিত্রটি যখন জ্বলজ্বল করে উঠে, তখন মনে হয় সত্যিই বুঝি স্বপ্ন আজ বাস্তব হওয়ার পথে।
সমগ্র পৃথিবী করোনা তান্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে যখন দিগ্বিদিকহীন হয়ে পড়েছে, উন্নত দেশ গুলো যখন কোনভাবেই আর পেরে উঠতে পারছে না, তখনই আশার বাণী নিয়ে আসে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের খবর। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই গবেষণা চালতে থাকে কিভাবে এ ভাইরাসকে দমন করা যায়। একেবারে নতুন প্রজাতির ভাইরাস হওয়ায় তার প্রতিষেধক নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। এর মাঝে বিশ্বের কয়েকটি দেশ ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের সুসংবাদ শোনায়, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান “গ্লোব বায়োটেক”। তাদের উৎপাদিত সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন ‘BANCOVID” এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশী হিসেবে এ সফলতা বিশ্ব দরবারে অনন্য।
চীনেই হুবেই প্রদেশ থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখনও আমরা ভাবতে পারিনি এ ভাইরাস কতটা দ্রুত ছড়াতে পারে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই চীন থেকে এ প্রাণঘাতী ভাইরাস বাংলাদেশে চলে আসে। সেই সাথে কয়েকদিনের মধ্যেই দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে ভাইরাস তার উপস্থিতি জানান দেয়। ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বের কোন দেশই এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। গত বছর চীনে এ ভাইরাসে আক্রমণ করলেও ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে চীন তাদের সফলতা এখনো দেখাতে পারেনি। অথচ ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের দৌড়ে তাদেরই থাকার কথা ছিল সবার সামনে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় একশতেরও বেশি দেশ ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ আবিষ্কারের দৌড়ে বাংলাদেশও থেমে নেই। গত ৮ মার্চ থেকে গ্লোব বায়োটেক তাদের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। bioRxiv নামক একটি জার্নালে “BANCOVID, the first D614G variant mRNA-based vaccine candidate against SARS-CoV-2 elicits neutralizing antibody and balanced cellular immune response” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যাতে গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আদ্যোপান্ত আলোচনা করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশ গুলোও ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে কোমড় বেঁধে নেমেছে। বৈশ্বিক এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও সদর্পে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তি দেশ গুলো ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে আছে। এদের মধ্যে কোনো দেশ ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে সফল হলেও, তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলো এ ভ্যাক্সিন সুবিধা কতটুকু পাবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কেননা আবিষ্কর্তা দেশ এবং তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাক্সিন সরবরাহ করার পর তবেই অন্যান্য দেশ এ ভ্যাক্সিন সুবিধা পাবে। সুতরাং এটি সহজেই অনুমেয় যে, ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের দৌড়ে যে সকল দেশ পিছিয়ে রয়েছে বা এখনো কার্যকর কোন সমাধানে যেতে পারে নি, তাদের জন্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ভয়াবহতা থেকে নিস্তার পাওয়া খুব কঠিন হবে।
গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রতিষ্ঠান হয়েও সফলতা অর্জনের পথে যতদুর এগিয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার। DRAFT landscape of COVID-19 candidate vaccines শিরোনামে গত ১৫ই অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকায় গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের তিনটি ভ্যাকসিনের নাম উল্লেখ করা হয়। ভ্যাক্সিন তিনটি হলো- DNA plasmid vaccine, Adenovirus Type 5 Vector এবং D614G variant LNP-encapsulated mRNA। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো ১৫৩টি ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেটও রয়েছে এ তালিকায়। তালিকায় আরো ৪২ টি ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট রয়েছে যাদের মধ্যে কিছু ভ্যাক্সিন ক্লিনিকেল ট্রায়ালের ১ম, ২য় ও ৩য় ধাপে রয়েছে। গত ৫ অক্টোবর তারিখে গ্লোব বায়োটেক ঘোষণা দেয়, তাদের D614G variant LNP-encapsulated mRNA ভ্যাকসিনটি ইঁদুরের ওপর প্রী-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সফল হয়েছে এবং ভ্যাকসিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত। গ্লোব বায়োটেক গত ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ ( আইসিডিডিআরবি) এর সাথে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা হিউম্যান ট্রায়াল এর জন্যে চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইতোমধ্যেই নেপাল তাদের দেশে হিউম্যান ট্রায়ালে আগ্রহী জানিয়ে সবুজ শংকেত দেখিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরের শেষে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে বাণিজ্যিকভাবে এই ভ্যাকসিনটি বাজারে ছাড়া হবে বলে আশা ব্যক্ত করে গ্লোব।
নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন ঔষুধ বা ভ্যাক্সিন চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষার মাধ্যমে স্বীকৃতি জানালে তবেই আমরা তাকে আবিষ্কার বলতে পারি। এ স্বীকৃতি অর্জনের পর তবেই সে পন্যের বানিজ্যিক উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমতি পাওয়া যায়। সম্প্রতি বিভিন্ন গনমাধ্যমে গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট গুলোকে “ভ্যাক্সিন আবিষ্কার” বলে প্রচার করা হচ্ছে। বুঝে না বুঝেই বিভিন্ন গনমাধ্যমে তা ঢালাও ভাবে “আবিষ্কার” বলে শেয়ার ও প্রচার করা হচ্ছে। ফলে তা হয়ে যাচ্ছে একরকম মিথ্যাচার। যে কোন চিকিৎসা পন্য বাজারজাতের পূর্বে তাকে অবশ্যই কিছু ধাপ অতিক্রম করে আসতে হয়। এ ধাপগুলোর মধ্যে রয়েছে – অনুসন্ধান পর্যায়, প্রি-ক্লিনিকাল পর্যায়, ক্লিনিকাল পর্যায়, নিয়ন্ত্রক পর্যালোচনা ও অনুমোদন, উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণ। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা হিউম্যান ট্রায়ালে ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিনটি কয়েকহাজার মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয় এবং ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও অন্যান্য বিষয় গুলো যাচাই বাছাই করা হয়। সবগুলো ধাপ সফলভাবে অতিক্রম করতে পারলে তবেই তাকে বানিজ্যিক ভাবে বাজারজাত এবং আবিষ্কারের খেতাব দেয়া হয়। গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই এনিমেল ট্রায়াল বা প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে।
ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর বরাবরই বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। কোভিড-১৯ নামক বৈশ্বিক এ দূর্যোগ সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। এমতাবস্থায়ও দেশীয় ঔষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড গবেষণা ও ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় যে চমক দেখিয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত। ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের পরবর্তী ধাপ গুলোতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা বজায় থাকলে, আশা করা যায় ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের এ অগ্রযাত্রা একদিন সফলতার মুখ দেখবে, বিশ্ব দরবারে শ্রদ্ধাভরে উচ্চরিত হবে বাংলাদেশ নামটি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।