ভ্যাক্সিন নিয়ে যত কথা

সপ্নীল আঁকাশ 

0
ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করতেছিলাম হঠাৎ  আমার এক ক্লাসমেট আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলো যে তার কিছু নতুন তথ্য প্রয়োজন করোনা ভ্যাক্সিন আবিষ্কার নিয়ে।তখন আমিও অনুভব করলাম এই সম্পর্কে আপডেট তথ্য জানা দরকার।বসে পড়লাম ল্যাপটপ নিয়ে। গুগল/ওয়েবসাইট অনেক খোঁজ  করে করোনা ভ্যাক্সিন নতুন নতুন তথ্য জানতে পারলাম যা পুর্বে আমার জানা ছিলোনা।যখন করোনা ভ্যাক্সিন নিয়ে বিভিন্ন আর্টিক্যাল পড়তেছিলাম, আমার মনে হলো এই সমস্থ তথ্যগুলো যদি একত্রে করে সবার কাছে উপস্থাপন করা যায় হয়তো অনেকের উপকার হবে।
আমরা জানি যে, বেশ কিছু ভ্যাকসিনের মানবদেহের পরীক্ষা ইতিমধ্যে সফল হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশ মানিবদেহে ব্যাবহারের জন্য অনুমোদনও দিয়েছে। কিন্তু এই ভ্যাকসিন কিভাবে তৈরি করা হলো তা হয়তো আমাদের সবার অজানা।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আশা করছি পড়লে আপনারা ভ্যাক্সিন সম্পর্কে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। ভ্যাক্সিন নিয়ে আলোচনা করার পুর্বে আমাদের ভাইরাস সম্পর্কে জানতে হবে।
ভাইরাস হলো জীব ও জড় জগতের মাঝে এক সেতুবন্ধন। যা জীবদেহের   বাইরে নিষ্ক্রিয় জড় পদার্থের মত আচরণ করে এবং জীবদেহ ছাড়া ভাইরাস নিজে নিজে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই ভাইরাসের বেঁচে থাকার জন্য দরকার একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হওয়া বা পোষক কোষ।যখন কোনো  ভাইরাস জীবদেহে প্রবেশ করে, তখন ভাইরাসটি  তার নিজের জীন থেকে ডিএনএ বা আরএনএ জীবদেহের কোষে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এবং জীবকোষের এনজাইম ব্যবহার করেই সে আরও অনেক প্রতিরূপ ভাইরাস কপি তৈরি করে।অর্থাৎ,আপনার বাড়িতে মেহমান হয়ে আসলো,আপনার বাসায় খাওয়াদাওয়া করলো এবং পরিশেষে আপনাকেই হত্যা করলো এরকম একটা ব্যাপার।
এখন আসা যাক,ভাইরাস আক্রমণের পরবর্তীতে আমাদের দেহে কি ঘটে,
ভাইরাসের এই আক্রমণ শুরু হয়ে গেলে আমাদের শরীরও এর বিরুদ্ধে একটা প্রক্রিয়া শুরু করে। আমাদের কিছু কোষ ভাইরাস এন্টিজেনকে ওই কোষপৃষ্ঠে প্রকাশ করে। তখন এটা থেকে আমাদের শরীরের অন্যান্য কিছু কোষ এই ভাইরাস এন্টিজেনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে এবং ভাইরাস ধ্বংস করতে থাকে। এই এন্টিবডি বনাম ভাইরাস যুদ্ধে এন্টিবডি একবার জয়ী হয়ে গেলে আমাদের শরীরের কিছু মেমোরি কোষ এই ভাইরাসের কোডটা ধরে রাখে। এভাবে কিছু ভাইরাসের বিরুদ্ধে সারা জীবন ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যায়।
 ভ্যাক্সিন আবিস্কার ও আধুনিক বিশ্বঃ
 পৃথিবীতে যতগুলো ভ্যাক্সিন এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে,করোনা বা কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের মত
 এত দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরি এবং মানবদেহে প্রয়োগের এমন নজির চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আর নেই।
আমরা যারা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে জড়িত বা পড়াশোনা করছি তারা হয়তো  ভ্যাক্সিন কিভাবে বানানো হয় সেই সম্পর্কে যথেষ্ট নলেজ রয়েছে।কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা রয়েছে,ফেসবুক এবং অন্যন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই দেখি ভ্যাক্সিন নিয়ে জানতে চায়। কিভাবে একটি ভ্যাক্সিন তৈরি করা হয়। ভ্যাকসিন গুলোতে মোটামুটি তিন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
 ১. ইন্যাক্টিভ ভ্যাকসিন: এক্ষেত্রে একটি ভাইরাসকে  নিষ্ক্রিয় করে মানুষের শরীরে ঢোকানো হবে। এটা দিয়ে আমাদের শরীর সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করবে। এরপর যদি নতুন করে আবার একটা সক্রিয় ভাইরাস ঢুকে পড়ে, তাহলে আমাদের শরীর আগে থেকেই প্রস্তুত। জলবসন্ত, এমএমআর ভ্যাকসিন ও পোলিও ভ্যাকসিন এভাবেই কাজ করে। এ পদ্ধতি আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত এবং প্রচলিত। কিন্ত এই পদ্ধতিতে অনেক মাস লেগে যায় ভ্যাকসিন তৈরি করতে। কারণ ভাইরাসকে আগে কালচার করা লাগে, তাকে নিষ্ক্রিয় করা লাগে ইত্যাদি। এ কারণে মাত্র ১০টা ভ্যাকসিন আবিষ্কারক এ পদ্ধতিতে চেষ্টা করছে করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য।
২. এন্টিজেন ভ্যাকসিন: এ ভ্যাকসিনে একটা ভাইরাসের  যে এন্টিজেনটা দিয়ে আমাদের শরীর তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে, সেই অংশটুকুই বা সেই এন্টিজেনের জন্য দায়ী ভাইরাসের জীনটুকু অন্য একটা ভাইরাস বা ছত্রাক দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো হয় যেটা আমাদের ক্ষতি করে না। এটির নিরাপত্তা আরও বেশি কিন্তু কার্যক্ষমতা প্রথমটির মত নিশ্চিত করতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়।  ভ্যাকসিন তৈরিতে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি । করোনা ভ্যাক্সিন তৈরির জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান এই পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছে। এর আগেও হেপাটাইটিস বি, হুপিংকফের ভ্যাকসিন এই পদ্ধতিতে  তৈরি করা হয়েছিল।
৩. এমআরএনএ ভ্যাকসিন: এ ধরনের ভ্যাকসিন হচ্ছে একদম নতুন একটি পদ্ধতি যা “next-generation” নামেও পরিচিত অর্থাৎ  এমন কোন ভ্যাকসিন যা এখনো বাজারে নেই আবিষ্কারের জন্য গবেষকরা চেষ্টা করে যাচ্ছে। সফল হলে এটা হবে সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন । এ ভ্যাকসিনগুলোতে যে কাজ করা হচ্ছে, তা হলো করোনাভাইরাসের যেই আরএনএ আমাদের শরীরে প্রবেশ করে অনেকবার প্রতিলিপন করছে, সেই আরএনএকে আলাদা করে শুধু ওটাকেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো। এমআরএনএগুলো আমাদের কোষে ঢুকে এন্টিজেন তৈরি করবে এবং সেটার বিরুদ্ধে আমাদের শরীর এন্টিবডি তৈরি করবে এটাই পরিকল্পনা। এমআরএনএগুলোকে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো হবে।
নতুন এই প্রযুক্তিতে এসেছে মডার্না কোম্পানির একটা mRNA ভ্যাকসিন, যেখানে করোনাভাইরাসের আরএনএকে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হবে। সেই আরএনএ আমাদের শরীরে ঢুকে ভাইরাসের এন্টিজেন তৈরি করবে। যার বিরুদ্ধে কাজ করে এন্টিবডি উৎপন্ন হবে।
আমরা অনেকেই হয়তো মনে মনে ভাবতেছি ভ্যাক্সিন আবিষ্কার এতো সহজ? ব্যাপারটা কিন্তু তা না।একটি ভ্যাক্সিন প্রস্তুতের  পর অনেকগুলো ধাপ রয়েছে।ভ্যাকসিনটির নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবহারের জন্যঃ
ধাপগুলি সহজভাবে বর্ননা করা হলোঃ
ধাপঃ১-. প্রথমে প্রিক্লিনিক্যাল ধাপ, যেখানে প্রস্তুতকৃত  ভ্যাকসিনগুলোকে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে কিছু কোষের উপর এবং এরপর জীবিত প্রাণী যেমন ইঁদুর বা বানরের উপর পরীক্ষা করে দেখা হবে যে এটা নিরাপদ কি-না, এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি-না ইত্যাদি। অনেক ভ্যাকসিন এই প্রথম ধাপেই ব্যর্থ হয়।যারা প্রথম ধাপে উত্তির্ন হয় তারাই ক্যাবল ২য় ধাপে যায়।
ধাপঃ-২. এরপর আসে ফেজ-১।  এই ধাপে ভ্যাকসিনগুলোকে কমসংখ্যক মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়, যেমন ১০-৩০ জন। এদের মধ্যে প্রথমে দেখা হয় যে, কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো কি-না, গুরুতর কিছু হলে ওখানেই সেই ভ্যাকসিনের ব্যবহার শেষ। এরসাথে আবার দেখা হবে যে, এন্টিবডি ঠিকমত কাজ করছে কি-না।
ধাপঃ-৩. ফেজ-২ঃ- এইধাপে  আরেকটু বড় ট্রায়াল করা হয়। কয়েকশ মানুষের উপর। কিছু মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন এবং কিছু মানুষকে অন্য একটি প্লাসেবো দিয়ে দেখা হবে যে, এই দুই গ্রুপের মধ্যে কী পার্থক্য আছে বা কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি-না। এতদূর এসেও কিন্তু অনেক ভ্যাকসিন আর এগোতে পারে না।
৪. ফেজ-৩ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  ধাপ। এখানে এসে কয়েক হাজার মানুষের উপর ট্রায়াল হয়। কিছু মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন, কিছু মানুষকে অন্য একটা ভ্যাকসিন দিয়ে দেখা হবে যে, তাদের উপর কোন ক্ষতি হচ্ছে কি-না। তাদের এক বছর বা তার বেশি ফলোআপ করা হবে, কারণ দেখতে হবে যে, এই এন্টিবডি যে তৈরি হচ্ছে; সেই এন্টিবডিগুলো ন্যূনতম বছরখানেক থাকছে না-কি। আর এভাবেই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লম্বা এক পথ অতিক্রম করতে হয় ব্যবহার উপযোগী হতে।
করোনা ভ্যাকসিনের দৌড়ে আছে প্রায় ১৭০টা গ্রুপ। কিছু ল্যাবে, কিছু মানুষের উপর ট্রায়াল শুরু করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে তিনটি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।
সর্বশেষ কথা হলো, ভ্যাকসিন তৈরি অনেক সময় ও ব্যয়বহুল একটি কাজ। একটা ভ্যাকসিনের জন্য দুটি বিষয় প্রয়োজন- নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতা। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ ইতিহাসে আমরা আগেই দেখেছি, তাড়াতাড়ি করে ও যথাযথ গবেষণা না করে ভ্যাকসিন বের করায় তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। এতে ক্ষতি দুটি- রোগীর ক্ষতি সাথে আবার জনসাধারণের সেই ভ্যাকসিনের উপর আস্থা কমে আসে। এ কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রথম জরুরি কাজ।
সবাই মাস্ক পড়ুন!! নিরাপদে থাকুন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ, ড্যাফোডিল  ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি  
মতামত দিন
Loading...