স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টদের ভুমিকা

আজিজুর রহমান শামীম

0

কটি আদর্শ চিকিৎসা ব্যাবস্থায় মূলত তিনটি পেশা জড়িতঃ ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট এবং নার্স। এই প্রত্যেকটি পেশার কাজের একটা নির্দিষ্ট পরিধি আছে। একজন ডাক্তারের কাজ হল রোগীর রোগ নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া। জার্মানির ফেডারেল মিনিস্ট্রি অফ এজুকেইশন এন্ড রিসার্চ অনুযায়ী মানুষের রোগের সংখ্যা সবমিলিয়ে প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো, অবশ্য এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার রোগ বিরল। আর এসব রোগের চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত প্রায় পনেরশ প্রকারের জেনেরিক ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (ইউএসএফডিএ)।

সঠিক রোগ নির্ণয়, রোগ চিকিৎসায় সঠিক ওষুধ নির্ধারণ ইত্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রকার শাখা তৈরি হয়েছে, কাজ করছে বিভিন্ন প্রকারের ডাক্তার। এর মধ্যে অন্যতম হল ফ্যামিলি প্র্যাকটিশিয়ান বা জেনারেল ফিজিশিয়ান, কার্ডিওলজিস্ট (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ), ডেন্টিস্ট (দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ),ডার্মাটলজিস্ট (চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ),হেপাটলজিস্ট, ইন্টারনাল মেডিসিন স্পেশালিষ্ট, গাইনিকলজিস্ট (স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ), নিউরোলজিস্ট (স্নায়ুতন্ত্র বিশেষজ্ঞ), নিউরোসার্জন, নেফ্রলজিস্ট (কিডনি বিশেষজ্ঞ), অনকোলজিস্ট (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ), অবেটেট্রিসিয়ান (প্রসূতি বিশেষজ্ঞ), অফথালমলোজিস্ট (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), ইএনটি স্পেশালিষ্ট (কান, নাক এবং গলারোগ বিশেষজ্ঞ), পেডিয়াট্রিশিয়ান (শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ), রেডিওলজিস্ট, রুমাটোলজিস্ট (বাতরোগ বিশেষজ্ঞ), সার্জন (শল্যবিদ), ইনফেকশাস ডিজিজ স্পেশালিষ্ট (সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ), ভেটেরিনারিয়ান (পশুরোগ বিশেষজ্ঞ), সাইকিয়াট্রিস্ট (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) ইত্যাদি।

এসব ডাক্তারেরও রয়েছে কাজের নির্দিষ্ট পরিধি। যেমন- একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান কখনো হার্টের অপারেইশন করেন না বা একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ দাঁতের চিকিৎসা করেন না। রোগের লক্ষণ, ব্যাপকতা এবং আরো কিছু ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে কোন ডাক্তার আপনাকে দেখবেন বা আপনি কোন ডাক্তার দেখাবেন। অনেক সময় কোন কোন রোগের চিকিৎসার জন্য কয়েকপ্রকার ডাক্তারের সম্মিলিত চিকিৎসা দরকার হয়।

সকল প্রকারের ডাক্তারি চিকিৎসার একটা কমন জিনিস হল প্রেসক্রিপশন। dictionary.com প্রেসক্রিপশনকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবেঃ a direction, usually written, by the physician to the pharmacist for the preparation and use of a medicine or remedy; অর্থাৎ, প্রেসক্রিপশন হল ডাক্তার কর্তৃক ফার্মাসিস্টের প্রতি ওষুধ তৈরি এবং ব্যবহারের একটি লিখিত নির্দেশনা। তার মানে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখবেন ফার্মাসিস্টকে উদ্দেশ্য করে। ফার্মাসিস্ট প্রেসক্রিপশন পড়ে সে অনুযায়ী রোগীর জন্য ওষুধ তৈরি করবেন, রোগীকে ওষুধ দিবেন এবং ওষুধের ব্যবহার রোগীকে বুঝিয়ে দিবেন।

ওষুধের প্যাকেটের গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দেবেন যাতে রোগীর প্রতি নির্দেশনা থাকবে কিভাবে ওষুধ ব্যবহার এবং সংরক্ষণ করতে হবে। একটা আদর্শ পদ্ধতিতে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ফার্মাসিস্টের কাছে সংরক্ষিত থাকবে, রোগী শুধু ওষুধের প্যাকেটের গায়ে ফার্মাসিস্টের লাগানো লেবেল অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করবেন। আপনাদের যাদের ইউরোপে বা আমেরিকায় থাকার বা চিকিৎসা নেয়ার অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা এই পদ্ধতির সঙ্গে অবশ্যই পরিচিত আছেন।

ফার্মাসিস্টের বাংলা প্রতিশব্দ হল ওষুধবিদ। আগে যেমন বলেছি ডাক্তাররা রোগ নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ওষুধ নির্ধারণ এবং প্রয়োগের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, তেমনি একজন ফার্মাসিস্ট ওষুধ তৈরি এবং এর সঠিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। আপাতদৃষ্টিতে ওষুধ তৈরী ব্যাতিত ফার্মাসিস্টের অন্য কাজগুলোকে সাধারন মানুষের নিকট অতো গুরুত্বপূর্ণ মনে নাও হতে পারে। তারা হয়তো ভাবতে পারেন ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম, ডোজ, কিভাবে খেতে হবে সব লিখে দিচ্ছেন এবং এখন যেহেতু সব ওষুধ তৈরিকৃত অবস্থায় ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়, তাহলে প্রেসক্রিপশনের ওষুধ রোগীকে দিতে একজন ওষুধবিদের আর কি দরকার? ডাক্তারের লেখা পড়তে পারে এমন কেউ ওষুধ দিলেই তো হল? আসুন একটি সত্য ঘটনা দিয়ে ওষুধের সঠিক এবং নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে ফার্মাসিস্টের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করি।

আমার এক আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু (আমার কলেজের বন্ধু এবং রাবির রসায়নের প্রাক্তন ছাত্র) কয়েকদিন আগে আমাকে ফোন করে তাদের একটি সমস্যার কথা জানালো। আমার বন্ধুর স্ত্রীর এর আগে পরপর দুবার মিসক্যারিয়েজ হয়েছে। তৃতীয়বার গর্ভধারণের পর যখন নিউইয়র্কে এক হাসপাতালে ডাক্তার দেখাল, ডাক্তার আগের দুবার গর্ভপাতের ইতিহাস জেনে, এবার যাতে আর গর্ভপাত না হয় সেজন্য কম ডোজের অ্যাসপিরিন (চাইল্ড অ্যাসপিরিন, ৮১ মি.গ্রা. করে দিনে একবার) প্রেসক্রাইব করলেন। আমার বন্ধু যখন ওই প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফার্মেসীতে গেল, তখন ফার্মাসিস্ট প্রেসক্রিপশন দেখে অ্যাসপিরিন ডিসপেন্স করতে রাজি হলেন না।

ফার্মাসিস্ট তাকে বুঝালেন যে অ্যাসপিরিনের রক্ত পাতলাকরণের ক্ষমতা আছে এবং এটা গর্ভের বাচ্চার রক্তপাত ঘটাতে পারে। পরামর্শ দিলেন প্রেসক্রিপশন নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যেতে এবং ডাক্তারকে ওষুধের নির্দেশনা পুনরায় বিবেচনা করতে। সে যখন ডাক্তারকে ফার্মাসিস্টের এই মতামত খুলে বললো ডাক্তার বেশ বিরক্ত হলেন এবং তার সিধান্তে অটল থাকলেন। এরপর ফার্মাসিস্টের আর কিছু করার রইলনা। ফার্মাসিস্ট অ্যাসপিরিন দিলেন। আমার বন্ধু এবং তার স্ত্রী পড়ে গেলো মহা চিন্তায়। ডাক্তার দেখানোর দুদিন পর্যন্ত আমার বন্ধুর স্ত্রী ভয়ে অ্যাসপিরিন খান নি। কারণ ফার্মাসিস্ট বলেছে এটা প্রেগন্যান্সিতে নিরাপদ নয়, আবার এদিকে না খেলে গর্ভপাতের ভয়। শেষ পর্যন্ত খাওয়া শুরু করলেন এবং কয়েকদিন খাওয়ার পর আবার গেলেন ডাক্তারের কাছে চেক আপের জন্য। পরীক্ষা করে দেখা গেলো, সত্যি সত্যি ফিটাসের রক্তক্ষরণ হয়েছে। এবার ডাক্তার অ্যাসপিরিন খাওয়া বন্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। কিছুদিন পড়ে যখন আবার চেক আপ করা হল তখন আর রক্তের দলাটা আর দেখা যায় নি। আলহামদুলিল্লাহ্‌।

ফার্মাসিস্টের কাজ কিন্তু আসলে এটাই। ওষুধের সঠিক, নিরাপদ এবং যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। চিকিৎসার ফলাফল যেহেতু ওষুধের সঠিক ব্যাবহারের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল, তাই একটি আদর্শ স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় ডাক্তার এবং নার্সের পাশাপাশি ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামুলক করা এখন সময়ের দাবী। প্রেসক্রিপশনের উপরোল্লিখিত অর্থ অবশ্যই সকল ডাক্তার জানেন। তাই তাদেরও উচিত দেশে ফার্মাসিস্টদের কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে এগিয়ে আসা। দেশে যখন গ্রাজুএইট ফার্মাসিস্ট ছিলোনা তখনকার কথা আলাদা।

কিন্তু এখন প্রতিবছর দেশে অনেক যোগ্য ফার্মাসিস্ট তৈরী হচ্ছে। আশার কথা হল সরকার সম্প্রতি মডেল ফার্মেসি চালুর মাধ্যমে, ফার্মাসিস্টদের চিকিৎসা সেবার মূল ধারায় নিয়ে আসতে উদ্যোগী হয়েছে। দেশের কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে বেশ কিছু ফার্মাসিস্ট ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে সুনামের সাথে কাজ করছেন। এখন সকল হাসপাতালে গ্রাজুএইট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করতে সরকারের দ্রুত উদ্যোগ নেয়া উচিত।

মোদ্দা কথা হলো, একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের যেমন হার্টের অপারেইশন করা উচিত নয়, তেমনি ওষুধের সঠিক এবং নিরাপদ ব্যাবহার নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব একজন ডাক্তারের নেয়া উচিত নয়। এতে রোগী সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয় এবং ওষুধের ভুল ব্যবহারের কারণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

 

মতামত দিন
Loading...