কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? এর সমাধান কি?

আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার রিজভী

0

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এটা কেবল একটা দাবিই নয়, বরং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা সিদ্ধ। আমাদের মস্তিষ্ক অন্যান্য সকল প্রাণির থেকে উন্নততম।তবে আমাদের মস্তিস্কের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সুইসাইডাল। অর্থাৎ নিজেকে নিজেই শেষ করে ফেলতে পারে!
ইন্টারেস্টিং না ব্যাপারটা?চলুন দেখা যাক কেন আমরা আত্মহনন করি? আর কি-ই বা এর সমাধান।

আত্মহত্যা বা সুইসাইড কি?

আত্মহত্যা মানে আত্মকে, মানে নিজেকে নিজেই হত্যা করা। মানুষ যখন বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, নিজের জীবনের উপর নিজেরই মহা বিতৃষ্ণা এসে যায়, তখনই সে আত্মহত্যা করে বা করার চেষ্টা করে।

বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ পুরুষ ও নারী আত্মহত্যা করে, যা যেকোনো যুদ্ধে নিহতের চেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন মানুষ আত্মহত্যা করে।এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে।

বহির্বিশ্বে ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি এবং তা অল্প বয়সীদের মধ্যে।পৃথিবীর ৫০% মানুষ তাদের জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে গিয়ে সুইসাইডাল চিন্তা করেছে,এর মাঝে ৫% সুইসাইড করার চেষ্টাও করেছে এক বা একাধিকবার।

আত্মহত্যার কারন কি কি?

মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন এর মধ্যে ডিপ্রেশন, ব্যক্তিত্বে সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতর মানসিক রোগ। তাছাড়া মাদকাসক্তি, এংজাইটি, অপরাধ বোধ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহ, প্রেম-কলহ, অভাব অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা, যৌন নির্যাতন, মা-বাবার ওপর অভিমান, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট, প্রেমে ব্যর্থ ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করেন। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে কারণ থাকে অজানা।

আমাদের ব্রেইনের MRI করে দেখা যায় যে,ফ্রন্টাল লোবের কার্যকরীতা সুইসাইডাল চিন্তাভাবনায় ডুবে থাকা মানুষের তূলনামূলক কম থাকে। সুইসাইডাল থিংকিং করা ব্যক্তির চিন্তাধারা,বিচার,ইমোশনাল ব্যালেন্স ধীরে ধীরে অনেকাংশেই কমে যেতে দেখা যায়।ব্রেইনে আগে কোন ট্রমা থাকলে তাও সুইসাইডের কারন হতে পারে।তাছাড়া, সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার কমে যাবার কারনে ব্রেইন সুইসাইডাল হয়ে যেতে পারে।

লক্ষণগুলো কি কি?

আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বা করতে পারেন এমন মানুষের মাঝে এই ব্যাপারগুলো দেখা যেতে পারে:

১. আত্মঘাতী কথাবার্তা :কখনো কি সুইসাইড নিয়ে ভেবেছিস ?সুইসাইড একটা মানুষ কিভাবে করে? সুইসাইডের বেস্ট ওয়ে কি? এই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।

২. প্রিয় জিনিসগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে: প্রিয় জিনিসগুলো প্রিয় কোন মানুষকে দিয়ে দেয়া এবং কোন আগ্রহবোধ না দেখানো।

৩. নিজের স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত হওয়া:মানুষের স্বপ্নই থাকে ভালো পড়াশুনা করে ক্যারিয়ার গড়া,বিয়ে করে পরিবার নিয়ে সুখে জীবন-যাপন করা,অর্থ উপার্জন করা।এই চিন্তাগুলো থেকে সুইসাইডাল চিন্তাভাবনায় নিমগ্ন মানুষেরা সরে আসে।

৪. অনিয়মিত ঘুমের ধরন:এটা অতিরিক্ত চিন্তাবোধ থেকে তৈরি হতে পারে,বিষন্নতা থেকেও হতে পারে।

৫. অবসাদগ্রস্ততা।
৬. সামাজিক জীবন থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
৭. নিজের প্রেম থেকে সরে আসা।
৮. ব্যক্তিগত ক্ষতিসাধন করা।
৯. বিপদজনক আচরন করা।
১০.অস্বাভাবিক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।

আমাদের এমন ব্যক্তির প্রতি করণীয় কি কি?

আমরা এমন লক্ষণগুলি কারো মাঝে দেখলে যা করতে পারি-

১.শান্ত থেকে তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারি।

২.তাদের ইমোশন এবং ফিলিংস গুলো যে অবাস্তব নয় তার সাথে একমত হয়ে যেতে পারি।

৩.তাকে ভরসা দিতে পারি যে আমি তার পাশে আছি সবসময়।

৪.তাদেরকে বলা যে তারা চাইলেই এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং অনেক চিকিৎসাই সাহায্য করতে পারে।

৫. তাদেরকে জীবন সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে পারি।

৬.তাকে ধর্মীয় কাজে অনুপ্রাণিত করতে পারি।

৭. পরিবারের সদস্যদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে এবং অভয় দিতে হবে।

৮. ডিপ্রেশনের নির্দিষ্ট কারন খুঁজে বের করে তার সমাধানের আশ্বাস দিতে হবে।

৯. বন্ধু ও পরিবারের মাঝে সবসময় ব্যস্ত রাখতে হবে।

১০. সবসময় তার ছোট ছোট কাজকেও প্রশংসা করতে পারি আমরা।

চিকিৎসা

সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে নানা প্রকারের কার্যকরী এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ, সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ডিপ্রেশনের রোগীকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা যায়। সাধারণত এমিট্রিপটাইলিন, সিটালোপ্রাম, এস-সিটালোপ্রাম, মিরটাজাপিন এন্টিডিপ্রেসেন্ট হিসেবে খুবই কার্যকরী।
একজন বিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট তাকে নানাভাবে কাউন্সিলিং করতে পারেন।

আমাদের আশেপাশে, আমাদের পরিবারে বা হয়ত আমাদের অনেক বন্ধু এমন সুইসাইডাল বিহেভিয়ার করতে পারে।খেয়াল রাখতে হবে তারা বলার আগেই আমরা যাতে এডভাইস দেয়া শুরু  না করি,তাদেরকে ছোট করে না দেখি।আমরা জাস্ট চুপ করে শুনলেও তারা আর আত্মহত্যার মতো ভয়ানক স্টেপে হয়তো পা বাড়াবেনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 

মতামত দিন
Loading...