ঔষধ সেবনের কিছু নিয়ম ও সাবধানতা

স্বপ্নীল আকাশ

0

আমাদের দেশ বহু জনসংখ্যার ছোট একটি দেশ।তাই মাঝে মাঝে শতভাগ সঠিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।প্রত্যন্ত গ্রামে যে মানুষগুলো আছেন তারা সবসময় ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন না। অসুস্থ হলে  কোনও প্রেসক্রিপশন ছাড়াই নিকটবর্তী ফার্মেসী দোকান থেকে ওষুধ ক্রয় করে সেবন করে থাকে এবং মনে করেন ফার্মেসীর দোকানদাররা ওষুধ সম্পর্কে সব কিছু জানেন তাই তারা কেবল দোকানদারের পরামর্শ নিয়েই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ  সেবন করে থাকেন। কারণ ডাক্তারের কাছে গেলে এতে তাদের খরচ বাড়বে। যা ঠিক নয়।

কোনো ওষুধই নিজে নিজে অথবা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া ঠিক নয়। সব সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করা জরুরি।  ওষুধ খাওয়ার সময় কিছু ভুলের কারণে রোগীরা ওষুদের  সম্পূর্ণ উপকারিতা পায় না বরং ভুল নিয়মে ওষুধ সেবন করার ফলে পরবর্তীকালে শরীরে নানান ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
২০১৬ সালের  একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর ৪ মিলিয়নের বেশি এশিয়া অঞ্চলের মানুষ  ভুল ওষুধ ব্যাবহার করে থাকে।   যেখানে বাংলাদেশে অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি। ভুল ওষুধ সেবনে আপনার যেমন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে তেমনি অনেক ওষুধ  আপনার শরীরে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে সেই ওষুধটি আপনারা শরীরে আর কাজ করছে না ।

আমরা ওষুধের ডোজ সম্পুর্ন করিনা।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের ওষুধের যথাযথ ব্যাবহার সম্পর্কে যতেষ্ট জ্ঞ্যানের অভাব রয়েছে। যখন কেও অসুস্থ হয় এবং ডাক্তারের কাছে যায় এবং যদি ডাক্তার তাকে ৭ দিনের ওষুধ দেয়।তিনি ৪/৫ দিন খাওয়ার পর সুস্থ হয়ে গেলেন।  তারপর ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খাওয়া বাদ দিয়ে দেয়। এর ফলে পরবর্তী শরীরে নানান ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাই অবশ্যই ওষুধের যথাযথ  ডোজ সম্পুর্ন করতে হবে।

অ্যান্টাসিড বা গ্যাস্টিকের ওষুধ গ্রহণ।

কিছুদিন পুর্বে আমার এক নিকট আত্মীয় অসুস্থতা অনুভব নিকটবর্তী  একটি ফার্মেসী থেকে প্যারাসিটামল এবং গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ক্রয় করেন।তখন আমি খেয়াল করলাম ওনি এন্টাসিড, প্যারাসিটামল এবং এন্টিবায়োটিক একসাথে সেবন করছেন।যা কখনো ঠিক নয়।আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে  সব ওষুধের সঙ্গে একত্রে অ্যান্টাসিড খেতে হয়। অ্যান্টাসিড বা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ অন্যান্য ওষুধের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বা এক ঘণ্টা পরে অ্যান্টাসিড খাওয়া উত্তম।

এক সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবন করা।

একটি ওষুধ আরেকটি ওষুধের কার্যক্ষমতা  কমিয়ে দিতে পারে বা বাড়িয়ে দিতে পারে। এটাকে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় বলা হয় মিথস্ক্রিয়া ( Drug interaction )।কখনো কখনো ডেকে আনতে পারে বিপদ এবং কি মৃত্যুও হতে পারে।এবিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবন করবেন ।

ওষুধের টাইম টেবিল মেইনটেইন  করা বা সময়ের ওষুধ সময়ে  খাওয়া।

ওষুধ খাওয়া বা সেবন করার জন্য সময়টা অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ। যখন আপনি অসুস্থ হলেন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ ক্রয় করে আনলেন। বাসায় এসেই ওষুধের ডোজ অনুযায়ী একটি চার্ট তৈরি করা উচিৎ কোন ওষুধ কখন সেবন করবেন সেই অনুযায়ী। এবং প্রতিদিন একই সময়ে ওষুধ সেবন করতে হবে।
ধরুন আজকে আপনি সকালে একটি এন্টিবায়োটিক খেলেন এটা আবার ৮ ঘন্টা পর খাওয়ার কথা। কিন্তু আপনি সেবন করলেন ১০ ঘন্টা পর।তাহলে কিন্তু আপনি ওষুধের যথাযথ কার্যক্ষমতা পাবেন না। ওষুধ বিজ্ঞানের ভাষায় একটা কথা আছে (Plasma Level  time curve) অর্থাৎ,প্রত্যেকটি ওষুধ Plasma level time curve অনুসরণ করে।

খাবার

ছোট বেলায় গ্রামে দেখতাম যে খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই সব ওষুধ একসাথে সেবন খেয়ে ফেলতেন অনেকেই। একদিন আমি আমার চাচাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা চাচা আপনি খাবার খাওয়ার সাথে সাথে ওষুধ সেবন করে ফেললেন কেন? ওনার উত্তর ছিলো এরকম যে ওষুধ যেহেতু খেতেই হবে তাই তাই ওষুধ এবং খাবার একসাথে খেয়ে নিলাম।
অর্থাৎ, অলসতার জন্য খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওষুধ খেয়ে নেয়।যা ঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে খাবার খাওয়ার অন্তত আধাঘন্টা  আগে বা পরে ওষুধ খাওয়া উচিৎ। তাছাড়া কিছু ওষুধ রয়েছে, যেগুলো খালি পেটে খেতে হয়। তা না হলে আপনি
ওষুধের যথাযথ কার্যক্ষমতা পাবেন না।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ওষুধ সেবন

বাংলাদেশ তথা বিশ্বে বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটা রোগ হচ্ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস যেকোনো বয়সে হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস  আক্রান্ত রোগীদের ওষুধ সেবন কিংবা ইনসুলিন নেওয়ার ক্ষেত্রে খাবার এবং ওষুধের সময় কখন হওয়া উচিত, ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করা উচিৎ।

ওষুধের ব্র‍্যান্ড

বাসায় আমার আম্মুকে গত তিনবছর যাবত দেখছি গ্যাস্ট্রিকের  ওষুধ হিসেবে রেনিটিডিন খাচ্ছেন।কিছুদিন পুর্বে  রেনিটিডিন ওষুধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্য ব্র‍্যান্ডের একটা ওষুধ সেবন করে ভালো কোনো কার্যক্ষমতা পাচ্ছেন না। তাই যদি একই ব্র্যান্ডের ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে খেয়ে থাকেন, তাহলে সেই ব্র্যান্ডের ওষুধই পরবর্তী সময়ে খাওয়া ভালো। আপনার শরীর সেই ব্র্যান্ডের ওষুধের ক্ষেত্রে দ্রুত সাড়া দেবে। তবে এ বিষয়ে শরীরের অবস্থা বুঝে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খেলেই সবচেয়ে ভালো।

কোমল পানীয়
আমাদের দেশে প্রায় ই দেখা যায় অনেকেই ওষুধ সেবন করার কিছুক্ষনের মধ্যেই সেভেন আপ বা অন্যান্য কোমল পানীয় পান করে থাকেন। যা ঠিক নয়।এতে ওষুধের কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।এবং বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।তাই সবচেয়ে ভালো হয়, ওষুধ সেবনের সময় এসব পানীয় এড়িয়ে গেলে।

গর্ভাবস্থায়

গর্ভাবস্থায় যেকোনো  ধরনের ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করা উচিৎ। মহিলারাও অনেক সময় তারা যে গর্ভবর্তী সে কথা ডাক্তারকে বলেন না। প্রথম তিন মাস যেহেতু গর্ভধারনের লক্ষণ বাইরে থেকে বোঝা যায় না সুতরাং ওষুধ খেলে বিপদ ঘটতেই পারে। একজন ভালো ডাক্তারের উচিত মহিলা গর্ভবতী কিনা তা অবশ্যই যেনে নেওয়া। মহিলারাও ডাক্তারের কাছে গেলে গর্ভবতী কিনা তা অবশ্যই বলা উচিত। প্রথম তিন মাস খুব বেশী সমস্যা না হলে ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। এতে গর্ভের বাচ্চার মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বিকলাঙ্গতা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
যেসব ওষুধ গর্ভাবস্থায় বর্জন করা উচিত তার একটি তালিকা দেওয়া হলঃ (১) নাইট্রাজিপাম, (২) এন্ড্রোজেনিক হরমোন, (৩) ক্যাপটোপ্রিল, (৪) ইনালাপ্রিল, (৫) ফেনিটোয়িন, (৬) লিথিয়াম, (৭) মেথিমাজোল, (৮) পেনিসিলামিন, (৯) টেট্রাসাইক্লিন, (১০) থ্যালিডোমাইড, (১১) ইথার, (১২) ভ্যালপ্রোয়িক এসিড, (১৩) ব্যথার ওষুধ যেমনঃ এসপিরিন, ইনডমেথাসিন, ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক ইত্যাদি। (১৪) আইসোট্রেটিনোয়েন যা একনি বা ব্রনে ব্যবহৃত হয়, (১৫) কিউমারিন জাতীয় ওষুধ, (১৬) বুসালফান, (১৭) সাইক্লোফসফামাইড ইত্যাদি।

অনেক ওষুধ রয়েছে, যেগুলো খাওয়ার পর অ্যালার্জির সমস্যা হয়। আপনার যদি অ্যালার্জির সমস্যা থাকে, তবে সতর্ক হয়ে ওষুধ খান এবং খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিজে নিজে কোনো ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবেন না বা শুরু করবেন না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি । 

মতামত দিন
Loading...